× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

পাহাড়ে জনবসতি ঘেঁষে অবৈধ ৬ ইটভাটা

এএম হোবাইব সজীব, কক্সবাজার

২৭ জানুয়ারি ২০২৩, ০১:৪৪ এএম

তিন পার্বত্য জেলায় ইটভাটা করার কোনো অনুমতি নেই। তারপরও পাহাড় কেটে, বনের কাঠ পুড়িয়ে কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী উপজেলার নাইক্ষ্যংছড়িতে অবৈধভাবে চলছে ৬টি ইটভাটা। আইনের তোয়াক্কা না করে জনবসতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বন ঘেঁষে গড়ে তোলা হয়েছে এসব ভাটা।

জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তিন পার্বত্য জেলায় ইটভাটার অনুমতি না দেওয়ার জন্য ২০০৮ সালে পরিপত্র জারি করা হয়। এ জন্য বান্দরবানে কোনো ইটভাটার অনুমতিপত্র দেওয়া হয় না এবং জেলায় বৈধ কোনো ইটভাটা নেই। তবে ১২টি ভাটার মালিক শর্ত সাপেক্ষে উচ্চ আদালতের আদেশে তাঁদের ভাটা পরিচালনা করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিবেশের জন্য অতিমাত্রায় ক্ষতিকর ২৫টি ড্রাম চিমনি, ১২০ ফুট উঁচু কংক্রিটের তৈরি চুল্লি ৩৪টি ও ৫টি জিগজ্যাগ পদ্ধতির ইটভাটায় ইট পোড়ানো হয়। লামায় ১৩টি, নাইক্ষ্যংছড়িতে ৬টি, থানচি, আলীকদম ও রুমায় ২টি করে ড্রাম চিমনির ইটভাটা আছে। ইট প্রস্তুত ও ইটভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বনাঞ্চল ও পাহাড়সংলগ্ন কোনো ইটভাটা স্থাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ইটভাটা পাহাড় কেটে জ্বালানি সংগ্রহের সুবিধার্থে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কাছাকাছি স্থাপন করা হয়েছে। ৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়সংলগ্ন ১২টি ইটভাটা নির্বিঘ্নে চলতে দেখা গেছে। অভিযোগ উঠেছে, সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে মোটা অংকের মাসোয়ারা ভিত্তিক চুক্তিতে এইসব ইটভাটা পরিচালা করছেন তারা।

সচেতন মহলের অভিযোগ, বাইশারীতে ১টি ইটভাটার পাশাপাশি নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় আরও ৬ ইটভাটা রয়েছে। সেগুলোও একই কায়দায় নিয়মবহির্ভূতভাবে চলছে। পাহাড়ি মাটি দিয়ে তৈরি করছে ইট। ভাটার পাশের পাহাড়গুলো কেটে সাবাড় করছে তারা। সরকারি বনের গাছ কেটে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রশাসনের অভিযান থেকে বাঁচার জন্য সামান্য কিছু কয়লা মজুদ করে রাখছেন ভাটার মালিকরা। ভাটাগুলো ফসলি জমি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে হওয়ায় জমির চাষে প্রভাব ফেলছে ও শিক্ষাঙ্গনের ব্যাপক ক্ষতি করছে।

স্থানীয়রা জানান, ভাটার বড় বড় গাড়ির আওয়াজে তারা সারারাত ঘুমাতে পারেন না। এছাড়া ভাটা সংলগ্ন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্টানে ধুলাবালি ও চুল্লির কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এখানে রয়েছে সামাজিক ও সংরক্ষিত বনের প্রচুর গাছ। পাহাড়ি এলাকার লোকজন জানান, প্রতি রাতেই ট্রাক ভরে বনের কাঠ যায় ভাটায়। দিনের বেলায়ই দেখা যায়, হায়দার ব্রিকসে কাঠ খালাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে একটি ট্রাক। এলাকাবাসীর আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে বন।

নাইক্ষ্যংছড়ির সোনাইছড়িতে দেখা যায়, বৈধ্যছড়ায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণে বৌদ্ধ বিহার, পশ্চিমে ফায়ার স্টেশনের মাঝামাঝি জায়গায় ৪টি ইটভাটার অবস্থান। এইচ কে বি ব্রিকস নামের একটি ইটভাটার মালিক হায়দার পাহাড় কেটে ৪টি ড্রাম চিমনিতে জ্বালাছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কাঠ। অথচ স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বৌদ্ধ বিহার এবং গ্রামের সঙ্গে ইটভাটার দূরত্ব মাত্র ৫০ ফুট।

সোনাইছড়ি বৈধ্যছড়া এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বললেন, বিদ্যালয়সংলগ্ন ইটভাটা বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন, স্মারকলিপিসহ বহু আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু মালিকের লম্বা হাত ও টাকার কারণে ইটভাটা বন্ধ হয়নি। পরে তিনি উচ্চ আদালতে ভুল তথ্য দিয়ে একটি রিট করে রেখেছে। ভারী যানবাহনের শব্দ, ধুলাবালুতে শিক্ষকেরা পাঠদান ও শিক্ষার্থীরা পাঠগ্রহণ করতে পারে না।

অন্যদিকে পাহাড় ঘেঁষে বাইশয়ারী ইউনিয়নের কাগজী ঘোনা গ্রাম সংলগ্ন পাহাড় কেটে ও কৃষিজমিতে স্থাপন করা হয়েছে এন এস বি একটি ইটভাটা। যা চলছে কয়েক বছর ধরে। মাসোয়ারা ভিত্তিক এই ভাটাটির শেল্টার দাতা হিসে রয়েছেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সচিব শাহ জাহান। তিনি সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ম্যানেজসহ ইটভাটাটির যাবতীয় দেখভাল করেছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া সোনাইছড়ির বৈধ্যছড়া এলাকায় বিপজ্জনকভাবে পাহাড় কেটে এফ ডি আর আর নামের আরো একটি ইটভাটা গড়ে তোলা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন কমিটির জেলা আহ্বায়ক জুম লিয়ান আমলাইয়ের ভাষ্য, পার্বত্য অঞ্চলে ইটভাটা স্থাপনের অনুমোদন না থাকলেও ক্ষমতাসীনরা এসবের তোয়াক্কা করে না। মূলত তারাই এসব ভাটা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত। আরণ্যক ফাউন্ডেশন ও তাজিংডংয়ে সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বান্দরবান জেলায় গত এক দশকে (২০১১-২০) কাঠ পাচার, তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ইটভাটায় জ্বালানি কাঠ ব্যবহারে সাড়ে চার হাজার একর প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ধ্বংস ও প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার বনভূমি উজাড় হয়েছে।

সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে পোড়ানো শুরু হবে কাঠ। এ জন্য লাকড়ি মজুত করে রাখে আগে থেকে। বৈধ্যঘোনার এইচ কে বি ব্রিকস মালিক হায়দার হোসেন, বাইশয়ারীর এন এস ব্রিকসের মালিক নাজমুল হক পিয়ারুসহ কয়েকজন জানিয়েছেন, একটি ইটভাটায় একদফা (১৬ দিন) ইট পোড়াতে গড়ে সাড়ে ছয় হাজার মণ জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন। একটি ইটভাটায় প্রতিবছর ১০ দফায় ৬৫ থেকে ৭০ লাখ ইট পোড়াতে গড়ে সাড়ে ৬৫ হাজার মণ জ্বালানি কাঠ লাগে। সেই হিসাবে, বান্দরবানের সাতটি উপজেলায় ৬৪টি ইটভাটায় প্রতিবছর ৪১ লাখ ৯২ হাজার মণ বা ১ লাখ ৬৬ হাজার টন বনাঞ্চলের গাছ পোড়ানো হচ্ছে।

আইন কী বলে:

ইট প্রস্তুত ও ইটভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনের ৫ (৩ক) ধারা অনুবলে, সরকার ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি সব উন্নয়ন কর্মকান্ডে (সড়ক ও মহাসড়ক ছাড়া) শতভাগ ব্লক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অর্থাৎ, কোনো ইট ব্যবহার করা যাবে না। ইটভাটায়ও ধাপে ধাপে ইট পোড়ানো কমিয়ে ব্লক তৈরি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। কিন্তু বান্দরবানে এখনো কোনো ইটভাটায় ব্লক তৈরি এবং সরকারি-বেসরকারি উন্নয়নকাজে ব্লকের ব্যবহার শুরু হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাইশয়ারী ইউনিয়নের পরিষদের চেয়ারম্যান আলম কোম্পানী জানান, যত্রতত্র ভাবে ইটভাটা গড়ে উঠায় তার ইউনিয়নে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিয়েছে এবং পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। ইটভাটার মালিকরা ইউনিয়ন পরিষদের কোন আইন কানুন মানেনা। গায়ের জোরে প্রতিদিন ২শত থেকে আড়াইশ ত ছোট- বড় ট্রাক দিয়ে ইট পরিবহনের দায়ে সরকারী অর্থায়নে নির্মিত সকল রাস্তা গুলো ভেঙ্গে গেছে।

এ ব্যাপারে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রোমেন শর্মা বলেন, ‘৩ পার্বত্য জেলায় ইটভাটা নির্মাণের কোনো অনুমতি নেই। তাই নাইক্ষ্যংছড়িতে যতগুলো ইট ভাটা আছে সবগুলো পুরোপুরি অবৈধ। শিগগির আমরা অভিযানে নামবো।’

পরিবেশ অধিদপ্তরের বান্দরবান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ফখরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘সামর্থ্য অনুযায়ী আমরা অবৈধ ভাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি। ফায়ার সার্ভিস, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবার সমন্বয়ে আমাদের এ কাজটি করতে হয়। 

Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.