× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও শহীদ আসাদ

রঞ্জন মল্লিক

২৭ জানুয়ারি ২০২২, ০৩:৪৩ এএম

১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলছিল। এ মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করা হয়। মামলার বিষয় ছিল, শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ভারতের আগরতলায় গিয়ে ভারতের সহায়তা আশা করে এবং বাঙালি সেনাবাহিনীর উচ্চ  পর্যায়েরর কর্মকর্তা ও বিভিন্ন পেশার মানুষকে নিয়ে এক চক্রান্তের জাল বিস্তার করেন।


মূলত এ মামলায় ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি জেল গেট থেকে শেখ মুজিবকে বন্দি করা হয়েছিল। শেখ মুজিবকে দীর্ঘদিন বিভিন্ন মামলায় বন্দি রাখার পর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বেকসুর খালাস দিয়েছিল এ দিন। তারপর আবারও জেল গেট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়,  ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি পেশ করার পর বিভিন্ন সভা-সমাবেশে এর পক্ষে জনমত তৈরি করতে থাকেন। ৬ দফার পক্ষে  গণমত সৃষ্টি হতে দেখে, পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা ভীত হয়ে পড়েন। এ সময় শেখ মুজিবের  বিরুদ্ধে  একের পর এক মামলা দায়ের করা হয়। হত্যা ও ধর্ষণের মামলা ছাড়া সব রকমের মামলাই তার বিরুদ্ধে ছিল। এ সময় মিথ্যা মামলায় তাকে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে দীর্ঘ সময়।

এসব মামলা থেকে জামিন পেলেও জেল গেট থেকে আবারও ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে তাকে রাজদ্রোহিতার অভিযোগে বন্দি করা হয়। সামরিক আদালতে তার বিচার শুরু হয়। বিচার প্রক্রিয়া এমনভাবে সাজানো হয় যেন তার ফাঁসি হয়। এই সময় বাংলার ছাত্রসমাজ আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে এসে দাঁড়ায়।
পাকিস্তানি দমননীতির বিরুদ্ধে এই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজ ফুঁসে ওঠে। শেখ মুজিবুর রহমান সহ রাজবন্দিদের মুক্তি কামনা করে ডাকসু সহ বিশ^বিদ্যালয়ের সকল ছাত্র সমাজ আন্দোলনে ঝঁপিয়ে পড়ে।

একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য ছাত্র সমাজ এ সময় একতাবদ্ধ হয়। ১৯৬৯ এর ৪ জানুয়ারি ডাকসু কার্যালয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপ এবং জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের এক অংশ এক সাংবাদিক সন্মেলন আহবান করে, শেখ মুজিবের ৬ দফার সাথে ছাত্র সমাজের আরও ৫দফা যোগ করে মোট ১১ দফা কর্মসূচি পেশ করে । শুরু হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচি। ৫ জানুয়ারির থেকে পূর্ব বাংলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে সারা দিয়ে রাজ বন্দিদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, রংপুর সর্বত্রই ছাত্র আন্দোলন চাঙ্গা হতে থাকে। এ সময় আওয়ামী লীগের প্রথম সারির সব নেতাই ছিলেন জেলে বন্দি।

পাকিস্তানি শাসক ও শোষকদের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার ছাত্র মাজ একত্র হলে পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের মতিভ্রম ঘটতে থাকে। তারা আন্দোলন থামাতে পেশি শক্তির ব্যবহার শুরু করে।

২০ জানুয়ারি গণআন্দোলনের মাইলস্টোন। এই তারিখের ঘটনায় বদলে যায় আন্দোলনের চরিত্র এবং এই আন্দোলন দ্রুত পরিণতির দিকে এগুতে থাকে। এই দিন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ পুলিশ ও ইপিআর জুলুমের প্রতিবাদে এবং ১১ দফার দাবিতে ঢাকা সহ প্রদেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পূর্ণ ধর্মঘট পালন করে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বটতলায় যে ছাত্র সভা আহবান করা হয় সেখানে হাজার হাজার ছাত্র লাঠি নিয়ে উপস্থিত হয়। শহীদ ঘটনাস্থলে ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের অন্যতম ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে মেডিকেল কলেজের ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হলে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। মুহুর্তেই  পরিস্থিতি ভিন্নরুপ ধারণ করে। একদিকে শোক, অন্যদিকে বারুদ। ছাত্রসমাজের উদ্ধমুখি বজ্রমুঠিতে শপথের উ”চারণ। ছাত্ররা শহীদ আসাদের লাশ সহ শহর প্রদক্ষিণ করতে চায় কিন্তু পারে না। পুলিশ ও ইপিআর বাহিনী সমগ্র এলাকা কর্ডন করে রাখে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তিন দিনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। কর্মসূচিতে ছিল ২১ জানুয়ারি হরতাল, ২২ জানুয়ারি শোক মিছিল এবং ২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মশাল মিছিল। পরে কালোপতাকাসহ বিশাল শোক মিছিল নগ্নপদে শহর পদক্ষিণ করে।
আসাদ ’৬৯-এর গণআন্দোলনে প্রথম শহীদ ছাত্রনেতা। ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান সম্পর্কে একটু ধারনা দেওয়া প্রয়োজন। ছাত্র ইউনিয়নের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাসের মেধাবী ছাত্র আসাদ। তিনি ১৯৬৬ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে বি.এ অনার্স পাস করেন। ১৯৬৮ সালে এমএ পরীক্ষায় অংশ নেন। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের এক মাস পর ফল বের হলে দেখা যায় তিনি এমএ  তে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন। শহীদ আসাদের বাবা এম.এ. তাহের ছিলেন নরসিংদী শিবপুর উ”চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মা মতিজাহান খাতুন নারায়ণগঞ্জ শহরের খ্যাতনামা আই.টি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক। আসাদের জন্ম ১৯৪২ সালে শিবপুর উপজেলার ধনুয়া গ্রামে। আসাদের বেড়ে ওঠা নরসিংদীর শিবপুরে। এখানেই তার ছাত্র রাজনীতির হাতেখড়ি। আসাদ ছিলেন প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির মন্ত্রে দীক্ষিত এক তরতাজা যুবক। নিজ উপজেলার শিবপুর ও নসিংদীতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এলাকার সাংগঠনিক কর্মকান্ডে জড়িত হন স্কুল জীবন থেকেই। অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ, শোষণ ও বৈষম্যহীন সমাজ এবং মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার ধ্যান ও জ্ঞান। শহীদ আসাদের জীবনে সিলেটের এম.সি কলেজের শিক্ষা ও রাজনীতি পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। ১৯৬০ সালে এস.এস.সি পাশ করে সিলেটের এম.সি কলেজে ভর্তি হন আসাদ। ছাত্র রাজনীতিতে এ সময় তিনি আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়েন। ছাত্র নেতা নুরুল ইসলাম নাহিদ একই আদর্শে বিশ্বাসী হওয়ায় তারা একে অপরের খুব ঘনিষ্ঠ হন কলেজে। ছাত্র রাজনীতিতে অধিক ঘনিষ্ঠ হওয়ায় শিক্ষা ক্ষেত্রে এক বছর পিছিয়ে যান আসাদ। ফলে তিনি ১৯৬৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও সংসদ নুরুল ইসলাম নাহিদ ও আসাদ উভয়ে ছিলেন হরিহর আত্মা। সংসদ নুরল ইসলাম নাহিদ এখনো আসাদের কথা বলে বেদনায় কাতর হন।

আসাদের মৃত্যুর ৩২ দিন পর ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্রমামলা প্রত্যাহার করে সকল অভিযুক্তদের বিনাশর্তে মুক্তি দেয় তৎকালীন আউযুবশাহী জালিম সরকার। মুক্তি লাভ করেই শেখ মুজিব ঘোষণা করলেন, ‘সংগ্রামী ছাত্ররা যে ১১ দফা দিয়েছেন, তার প্রতি আমারও সমর্থন রইল। কারণ ১১ দফার মধ্যে আমার দলের ৬ দফার রুপরেখাও রহিয়াছে।’ পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে সম্বর্ধনা জানানো হয় রেসকোর্স ময়দানে। এই সভায় শেখ মুজিবকে  বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেন, ‘গোল টেবিলে বসে ৬ দফা ও ১১ দফা আদায় করে আনব, অন্যথায় গোল টেবিল বর্জন করব। তিনি তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে ইসলামাবাদ যড়যন্ত্রমামলা নামে অভিহিত করার জন্য জনগণকে আহ্বান জানান।’

১৯৬৯-এর গণআন্দোলন জাতীয় চেতনার প্রতিক, একুশে ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। যদিও ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট ২১ ফেব্রুয়ারিকে ছুটির দিন ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারির পর এই ছুটির দিন বাতিল হয়ে যায়। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ২১ ফেব্রুয়ারির হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনে। সরকার ১৯৬৯ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।

১৯৪৮ এর ৩১ ডিসেম্বর ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সন্মেলনে মূল সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা।’  ঊনসত্তরের গণআন্দেলনে এই বাস্তব কথাটি অনিবার্য করে তোলে।

আসাদকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন বরেণ্য কবি শামসুর রহমান। ‘আসাদের শাট’ আহা, সেকি কথা মালা। আসাদের নামে জিন্না গেট হয়েছে আসাদ গেইট। নরসিংদী শিবপুরে শহীদ আসাদ কলেজ ও  নরসিংদী শহীদ আসাদ কলেজিয়েট গার্লস হাই স্কুল যা আসাদের স্মৃতি বহন করছে। ২০১৮ সালে আসাদকে  সর্বো”চ বেসামরিক পদক, মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করেছে বাংলাদেশ সরকার।

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে আসাদ প্রথম শহীদ ছাত্রনেতা। তারপর ২৪ জানুয়ারি, মিছিলে গুলিবর্ষণ করে সেনাবাহিনী। সেক্রেটরিয়েটের সামনে প্রথম মৃত্যুবরণ করেন রুস্তম। পরবর্তী পর্যায়ে গুলিতে নিহত হন  ঢাকার নবকুমার ইনিস্টিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্র মতিউর। সমগ্রনগরী বিক্ষোপে কাঁপে। ওই দিন সেনাবাহিনী আদমজীনগরী ও নারায়ণগঞ্জে গুলি বর্ষণ করে। খুলনার দৌলতপুর ও খালিসপুর এলাকায় পুলিশের গুলিতে তিনজন নিহত ও বহু আহত হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি শহীদ হন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক। তাকে ক্যন্টনমেন্টের ভেতরে বন্দি অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয়। প্রেসনোটে বলা হয়, আসামি পালাতে চেষ্টা করেছিল বলেই গুলি ছোড়া হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের দমন করার সময় বিশ^বিদ্যালয়ের  প্রোক্টর ও  রসায়ন বিভাগের রিডার  ডক্টর  শামসুজ্জোহাকে বিশ^বিদ্যালয়ের গেটের সামনে পাকিস্তানি সেনারা বেয়োনেট চার্জ করে  নির্মমভাবে হত্যা করে। একই দিনে নিহত হন ছাত্র নুরুল ইসলাম। গুরুতর আহত হলেন ড. মাজাহারুল ইসলাম, আব্দুল খালেক এবং ড. মোল্লাসহ বহু সংখ্যক ছাত্র শিক্ষক। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে আসাদের সর্বাগ্রে চরম আত্মত্যাগ ছাত্রসমাজকে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল, এতে সন্দেহের কোন াবকাশ নেই। সেই ধারাবাহিকতায় উনসত্তরের গণআন্দোলনে প্রাণ দিয়েছিল এদেশের সাহসী র্কীতি সন্তানরা।  যার ফলশ্রুতিতে ফিল্ড মার্শাল আউয়ুব খান , দড়ির এক হেচকা টানে উল্টে পড়েন। পাকিস্তানি সামরিক শাসনের দম্ভ এক মুহূর্তে চুরমাচুর হয়ে যায়।  

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও চরম আত্মত্যাগের পথ প্রদর্শক শহীদ আসাদ আজ একই সূত্রে গাঁথা। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের  ছাত্র নেতা আসাদ বাঙালির হৃদয়ে জাগুরুক থাকবেন চিরদিন। জয় বাংলা।  

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক





Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.