× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

ইরান-রাশিয়া-চীনের যৌথ মহড়ার গুরুত্ব কী?

সিরাজুল ইসলাম

২৫ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:০৩ এএম

ইরান, রাশিয়া ও চীন ভারত মহাসাগরের উত্তরাংশের ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় দুইদিনব্যাপী নৌ মহড়া চালিয়েছে। সামরিক সহযোগিতা বাড়ানো এবং সমুদ্র নিরাপত্তা জোরদার করার লক্ষ্য নিয়ে গত ২১ জানুয়ারি শুক্রবার থেকে মহড়া শুরু হয়। ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ইরনার তথ্য মতে- ‘২০২২ মেরিন সিকিউরিটি বেল্ট’ নামের এ মহড়ায় ইরান, রাশিয়া ও চীনের মেরিন এবং এয়ারবোর্ন ইউনিট অংশ নেয়। ইরানের প্রেসিডেন্ট সাইয়্যেদ ইবরাহিম রায়িসি দুইদিনব্যাপী রাশিয়া সফর শেষ করে দেশে ফেরার মুহূর্তে ত্রিদেশীয় এই মহড়া শুরু হয়। এখানে বলে রাখি- রাশিয়া সফরের সময় মস্কো ও তেহরানের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে প্রেসিডেন্ট রায়িসি বিশেষ জোর দিয়েছেন। রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনও সে আহ্বানে যথাযথভবে সাড়া দিয়েছেন। যার কারণে ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে ২০ বছর মেয়াদি কৌশলগত চুক্তির রোডম্যাপ তৈরির জন্য দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

যাহোক, ত্রিদেশীয় মহড়ার মুখপাত্র ইরানি সেনা কর্মকর্তা রিয়ার অ্যাডমিরাল মোস্তফা তাজউদ্দিনি জানান- ইরান, রাশিয়া ও চীনের অংশগ্রহণে এটি তৃতীয় মহড়া এবং ভবিষ্যতেও এমন মহড়া অব্যাহত থাকবে।

রিয়ার অ্যাডমিরাল তাজউদ্দিনি যে তথ্য জানিয়েছেন তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জানিয়েছেন, এবারের মহড়ার লক্ষ্য ছিল আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোরদার করা এবং তিন দেশের মধ্যে বহুপক্ষীয় সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা করা। এছাড়া বিশ্ব শান্তি এবং সমুদ্র নিরাপত্তার প্রতি তিন দেশের যৌথ সমর্থনের বিষয়টিও মহড়ার মাধ্যমে তুলে ধরা আরেকটি লক্ষ্য ছিল। পাশাপাশি জলদস্যুদর বিরুদ্ধে লড়াই, আন্তর্জাতিক সমুদ্র বাণিজ্যের নিরাপত্তা, সমুদ্র সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা এবং বিভিন্ন ধরনের অভিযান পরিচালনার কৌশলগত অভিজ্ঞতা ও তথ্য বিনিময় করাও এই মহড়ার কয়েকটি লক্ষ্য।

ইরানের নৌবাহিনীর ১১টি ইউনিট, ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র তিনটি ইউনিট, রাশিয়ার নৌবাহিনীর তিনটি ইউনিট এবং চীনা নৌবাহিনীর দু’টি ইউনিট এ মহড়ায় অংশ নেয়। আগুন লেগে যাওয়া গানবোট ও অপহৃত যুদ্ধজাহাজ উদ্ধার, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে গুলি ও গোলাবর্ষণ এবং রাতের অন্ধকারে আকাশে থাকা লক্ষ্যবস্তুকে গুলি করে ভূপাতিত করার মতো অনুশীলন করা হয়েছে মহড়ায়।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন সময় জোটবদ্ধ হয়ে এমন মহড়া চালায়। সে দৃষ্টিকোণ থেকে এই সামরিক মহড়া অনেকটা স্বভাবিক ব্যাপার। কিন্তু মহড়ার ধরন ও প্রেক্ষাপট দেখে বোঝাই যাচ্ছে- তিন দেশের এই মহড়া শুধুমাত্র কোনো উদ্ধার অভিযান বা জলদস্যুতা প্রতিরোধের জন্য চালানো হয় নি, শত্রুপক্ষের হামলা মোকাবেলা ও শত্রুকে ঘায়েল করার কৌশল চর্চা করা হয়েছে। এই মহড়া চালানো হয়েছে এমন সময় যখন ইসরাইল ও আমেরিকা ইরানে সামরিক আগ্রাসন চালানোর হুমকি দিচ্ছে, আমেরিকা রাশিয়ার বিরুদ্ধে হুমকি দিচ্ছে এবং আমেরিকা ও তার মিত্ররা চীনের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিচ্ছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নানা ঘটনার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় মহড়াটি অত্যন্ত ক্রিটিক্যাল একটি সময়ে অনুষ্ঠিত হলো সেকথা বলতে কোনো দ্বিধা নেই।

ইরানের একজন কর্মকর্তা মহড়া সম্পর্কে পরিষ্কার করে বলেছিলেন যে, এই মহড়ার লক্ষ্য হচ্ছে আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং এর ভিত্তি জোরদার করা, আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন দেয়ার জন্য এই তিন দেশের মধ্যে বহুপক্ষীয় সহযোগিতা বিস্তার, সমুদ্রপথে নিরাপত্তা এবং অভিন্ন ভবিষ্যতের জন্য একটি মেরিটাইম কমিউনিটি গড়ে তোলা। বলার অপেক্ষা রাখে না- এর প্রত্যেকটি লক্ষ্য খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ এবং সুদূর প্রসারী চিন্তা-ভাবনার আলোকে নির্ধারিত হয়েছে। তবে এই মহড়ার মধ্যদিয়ে নতুন যে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে তাহলো- আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইরানের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি। রাশিয়া ও চীন আগে থেকেই অর্থনৈতিক এবং সামরিক দিক দিয়ে যথেষ্ট এগিয়ে ছিল। তাদের কাতারে ইরান এই মহড়ার মধ্যদিয়ে আলাদা জায়গা করে নিল যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নানা আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করতে বাধ্য হবে।

ইরান, চীন এবং রাশিয়ার এই যৌথ মহড়ার আলাদা রাজনৈতিক গুরুত্বও রয়েছে। এই মহড়ার মধ্যদিয়ে পরিষ্কার হচ্ছে যে- রাশিয়া এবং চীন নিশ্চিতভাবে ইরানের বৈধ বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রতি সমর্থন দিয়েছে, বিশেষ করে সমুদ্র বাণিজ্যের প্রতি। রাশিয়া এবং চীন দীর্ঘদিন থেকে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির প্রতিও সমর্থন দিয়ে আসছে। এছাড়া, আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ইরানকে শক্তিশালী হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহী করে তুলেছে এই দুই দেশ। ইরান শক্তিশালী হলে এই অঞ্চলে পশ্চিমা হস্তক্ষেপ অনেক কমে যাবে বলে মনে করে তারা। রাশিয়া এবং চীন দু দেশই মনে করে, ইরান সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী হলে সে নিজেই কার্যকরভাবে পশ্চিমা দেশগুলোর হুমকির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবে।

অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই মহড়ার গুরুত্ব বুঝতে গেলে সবার আগে ইরান, রাশিয়া ও চীনের বৈদেশিক বাণিজ্যের ধরণটি বুঝতে হবে। এই তিন দেশই বাণিজ্য ক্ষেত্রে শিপিং লাইনের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। সেজন্য চীন, রাশিয়া এবং ইরানের বাণিজ্যের জন্য আন্তর্জাতিক শিপিংয়ের নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়ার বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কার্গোজাহাজের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ইরানও তার তেল রপ্তানির ক্ষেত্রে জাহাজের ওপর নির্ভরশীল। চীনের তেল এবং গ্যাস আমদানির বিষয়টি এবং আরো বেশকিছু বৈদেশিক বাণিজ্য জাহাজ চলাচলের ওপর নির্ভরশীল। ফলে জাহাজ চলাচলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এই তিন দেশের অর্থনীতিকে ধরে রাখার জন্য খুবই জরুরি।

এছাড়া চীন, রাশিয়া এবং ইরান বিশেষ করে আঞ্চলিক বলদর্পিতা এবং সমুদ্রে জলদস্যুতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে এই তিন দেশ পারস্পরিক সহযোগিতার দিকে ঝুঁকেছে। এই মহড়া এমন একটি পয়েন্টে অনুষ্ঠিত হয়েছে যেটি ভারত মহাসাগরের উত্তরাংশ, ওমান সাগর এবং হরমুজ প্রণালীর মুখে অবস্থিত। এই অঞ্চলটি আন্তর্জাতিক তেল পরিবহনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চেক পয়েন্ট।

বেইজিংয়ে অবস্থিত ইউয়ান ওয়াং মিলিটারি সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের গবেষক ঝু চেনমিং এই মহড়াকে পূর্বঘোষিত স্বাভাবিক ঘটনা বলে উল্লেখ করলেও তিনিই আবার ওমান সাগর এবং আশপাশের পানিসীমার নিরাপত্তা রক্ষার বিষয়ে চীনের অংশগ্রহণকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, সারা বিশ্বের মোট তেলের এক-পঞ্চমাংশ হরমুজ প্রণালী দিয়ে পরিবহন করা হয় যেখানে চীনের কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে অনেক বেশি। এই পথেই চীনের বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পন্ন হয় এবং চীনা জাহাজ পণ্য নিয়ে ইউরোপের দেশগুলোতে যায়। সেই সব জাহাজ ফেরার পথে আবার তেল পরিবহন করে। অন্যদিকে রাশিয়ার জন্য এই মহড়ার গুরুত্ব হচ্ছে- যখন মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি কমছে তখন সেখানে রাশিয়া নিজের প্রভাব বলয় বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

সদ্য সমাপ্ত এই মহড়া নিয়ে খোদ মার্কিন মুুল্লুকেও রয়েছে নানা বিশ্লেষণ। ইরান, রাশিয়া ও চীনের সমন্বয়ে চালানো যৌথ এই মহড়াকে আমেরিকার জন্য কঠোর বার্তা বলে মন্তব্য করেছে মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন টাইমস। প্রশ্ন হ”েছ- দেশ তিনটি কী বার্তা দিয়েছে?

ওয়াশিংটন টাইমসের মূল্যায়ন বিশ্লেষণ করতে গেলে একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যেভাবে আমেরিকা একাধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল বা এখনো বিভিন্ন ইস্যুতে যেভাবে নিজের দাপট ও প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখাতে চায়, এখন সেই দাপট-প্রভাব প্রতিপত্তি দেখাতে গেলে একেবারে বিনা চ্যালেঞ্জে পার পেয়ে যাবে সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই এবং এ ব্যাপারে বিশেষ করে বিশ্ব অঙ্গনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ একতাবদ্ধ, ঐক্যবদ্ধ। এই তিনটি দেশ হচ্ছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান, রাশিয়া ও চীন। ঘটনাক্রমে তিনটি দেশই মার্কিন বলদর্পিতার শিকার। এরা সবাই গত কয়েক বছর ধরে দফায় দফায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছে। এছাড়া, প্রতি মূহূর্তে তিনটি দেশের বিরুদ্ধে আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্ররা নানা ধরনের হুমকি দিয়ে চলেছে। এ সমস্ত নিষেধাজ্ঞা হুমকিসহ নানা ধরনের জটিলতা মোকাবেলা করে ইরান, চীন ও রাশিয়া এগিয়ে চলেছে এবং তারা ক্রমেই জোটবদ্ধ হচ্ছে -এটি পরিষ্কার হয়ে উঠছে। পাশাপাশি একথাও পরিষ্কার যে, আমেরিকা যদি এই তিনটি দেশের কোনো একটির বিরুদ্ধে কোনো রকমের সমরিক আগ্রাসন চালানোর চেষ্টা করে বা কোনোরকমের ভুল পদক্ষেপ নেয় তাহলে এই তিনটি দেশ সম্ভবত ঐক্যবদ্ধভাবে তা মোকাবেলা করবে। আমরা জানি, এরইমধ্যে চীনের সঙ্গে ইরানের ২৫ বছর মেয়াদি একটি কৌশলগত চুক্তি হয়েছে এবং খুব সম্প্রতি তা বাস্তবায়নও শুরু হয়েছে।

এ চুক্তির আওতায় ইরান ও চীনের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা থাকবে। রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের আরেকটি চুক্তির প্রক্রিয়া চলছে। আমার মনে হয় সেই চুক্তি হবে আরো ঘনিষ্ঠ। অর্থাৎ চীন ও ইরানের মধ্যে যে কৌশলগত চুক্তি হয়েছে তার চেয়ে রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের সামরিক দিক দিয়ে আরো জোরদার চুক্তি হবে। সেক্ষেত্রে আমেরিকার সামনে আসলে আগামী দিনগুলো অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। এই মহড়ার ভেতর দিয়ে সে বার্তাই দেয়া হয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইরান, রাশিয়া ও চীনের অংশগ্রহণে একটি জোট গড়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল বলে মনে করা হচ্ছিল। এই মহড়া হয়ত সে ইঙ্গিতও দিয়ে গেল। তিন দেশ ক্রমেই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছে, বাড়ছে পারস্পরিক সহযোগিতা- তা তো দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমেরিকা কী পদক্ষেপ নেয় সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে মধ্যপ্রাচ্যসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মার্কিন দাপট কমছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই অবস্থায় আমেরিকা ও তার মিত্ররা অনেক বেশি কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না।

লেখক: সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক


Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.