× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

বর্বরতার ছায়া সরুক

স্মৃতি চক্রবর্তী

২৪ জানুয়ারি ২০২২, ০৪:৩৯ এএম

দেশের পর্যটনের বিকাশে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে যখন নানা পরিকল্পনা বিস্মৃত হচ্ছে, তখনই দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজারে বিশ্বের দীর্ঘ সমুদ্রসৈকতে গত বছরের ডিসেম্বরে ঘটে গেল বর্বরোচিত ঘটনা। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে এই ঘটনা যে বার্তা দিয়েছে তা পর্যটনের বিকাশে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। আমরা জানি, কক্সবাজারসহ দেশে অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর অনেক পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে যেগুলোর দিকে পর্যটকদের রয়েছে বিশেষ আকর্ষণ। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, দেশের প্রতিটি পর্যটন কেন্দ্রেই অনেক সমস্যার পাশাপাশি নিরাপত্তাজনিত সমস্যা কী ভয়াবহভাবে জিইয়ে আছে ফের এরই নজির মিলল সম্প্রতি কক্সবাজার সৈকতে।

এর আগে আমরা সংবাদমাধ্যমে দেখেছি দেশের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে পর্যটকদের নানা রকম বিড়ম্বনায় পড়ার খবর। সার্কভুক্ত দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপের মতো দেশও পর্যটনের বিকাশে কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিত করে এই খাতটিকে শিল্প হিসেবে গড়ে তুলছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পর্যটনকেন্দ্রিক আয় জাতীয় অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে আমাদের অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা তা কাজে লাগাতে পারছি না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত কিংবা যোগাযোগসহ কিছু সমস্যা জিইয়ে থাকলেও নিরাপত্তাজনিত সমস্যা প্রায় সর্বত্রই বিরাজমান। এই পরিস্থিতিতে আমরা বিকশিত পর্যটন খাতের স্বপু দেখি কী করে?

সম্প্রতি কক্সবাজারে সৈকতের লাবনী পয়েন্টে বেড়াতে যাওয়া সন্তানসহ দম্পতির ওপর দুর্বৃত্তের হামলে পড়ার যে ঘটনা ঘটেছে, তা সভ্যতা-মানবতার কলঙ্ক তো বটেই, কীভাবে এই সমাজ ক্রমাগত দুর্বৃত্তদের চারণভূমি হয়ে উঠছে, এরও অনাকাক্সিক্ষত নজির মিলল। স্বামী-সন্তানকে জিম্মি করে একজন নারীকে সৈকত থেকে দুর্বৃত্তরা তুলে নিয়ে দু-দফায় ধর্ষণ করে একটি রিসোর্টে আটকে রেখে তাদের দাপটের যে দৃষ্টান্ত দাঁড় করিয়েছে, এর প্রেক্ষাপট বিচারে ব্যাখ্যা হতে পারে নানা রকম এবং এর কোনোটিই শান্তিপ্রিয় মানুষ ও সমাজের জন্য প্রীতিকর নয়। কক্সবাজারের কুখ্যাত সন্ত্রাসী ওই ঘটনার মূল হোতা আশিকুর রহমান আশিক ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্রে এতটা দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল কী করে? ১৬টি গুরুতর মামলার আসামি আশিক কয়েক দিন আগে জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের জনৈক কর্মকর্তা আশিক এবং তার বাহিনীর দুষ্কর্মের খতিয়ান সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেছেন। সাংবাদিকদের অনুসন্ধানেও বেরিয়ে এসেছে আশিকসহ তার সাঙ্গোপাঙ্গদের স্থানীয় ক্ষমতাবান রাজনীতিকদের ছায়াতলে আশ্রয়ের খবরও। ২৬ ডিসেম্বর রাতে আশিককে মাদারীপুর থেকে র‌্যাব সদস্যরা গ্রেপ্তার করেছেন। এর আগে-পরে পুলিশ আরও কয়েকজনকে গ্র্রেপ্তার করে। অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অভিজ্ঞতা প্রীতিকর নয়। কাজেই আশিক কিংবা তার সহযোগীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিয়েও সংগতই সংশয় থেকে যায় অনেকের মনে। বিচার প্রক্রিয়া শুরুর আগেই স্থানীয় পুলিশের ভূমিকা এমন সংশয় আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার নারী বা পুরুষ যে-ই হোন না কেন, তার সামাজিক অবস্থান, পেশাগত পরিচয় ইত্যাদি কোনো কিছুই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কোনো মহলের কাছেই বিবেচ্য বিষয় না হয়ে ভিকটিম যথাযথ প্রতিকার পাবেন এটাই খুব স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু অনভিপ্রেত হলেও সত্য, অনেক ক্ষেত্রেই আমরা এমনটি দেখি না। কক্সবাজারে ওই ধর্ষিতার ক্ষেত্রেও দায়িত্বশীল কোনো কোনো মহলের পক্ষ থেকে যে দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটেছে, তা শুধু নিন্দনীয় নয়, বিস্ময়কর এবং প্রশুবোধকও! পুলিশ ও র‌্যাবের বক্তব্য পরস্পরবিরোধী। তাছাড়া এই মামলার বাদী নির্যাতিতার স্বামী ঢাকায় ফিরে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, চাপে পড়ে তাকে বলতে হয়েছে শেখানো কথা! এমতাবস্থায় ন্যায়বিচারের আশা কতটা করা যায়? একজন দুর্বৃত্তের নেতৃত্বে দলে দলে ভাগ হয়ে ব্যাপক জনসমাগম কেন্দ্র কক্সবাজারে দাপটের সঙ্গে দুষ্কর্ম চালিয়ে যাওয়ার যে খবর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল সহৃত্রের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে, তাতে প্রতীয়মান হয়, এ রকম আশিকের এই সমাজে ক্ষণে ক্ষণে জন্মানোর আঁতুড়ঘর অনেক। নীতি-আদর্শবিবর্জিত রাজনীতিকদের যে ছায়াতলে আশিকরা বেড়ে ওঠে, সেই ছায়ার উৎস নির্মহৃল করতে না পারলে সমাজের বিবর্ণতা মুছে ফেলা সহজ হবে না। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক দায়িত্বশীলের ব্যর্থতা, অর্বাচীনতা কিংবা অপরাধীর সঙ্গে সখ্যের মতো গুরুতর নেতিবাচক বিষয়গুলোর দিকেও রাষ্ট্রশক্তিকে সমগুরুত্ব দিয়েই দৃষ্টি দিতে হবে। সংবাদমাধ্যমেই উঠে এসেছে এ রকম আরও কয়েকটি গ্যাং কক্সবাজারে দুষ্কর্ম চালাচ্ছে! এর দায় কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো এড়াতে পারে?

নারী এখন আমাদের দেশে অবরোধবাসিনী নন তা বহুলাংশে সত্য হলেও এখনও নারীর নিরাপত্তাহীনতা যে প্রকটই রয়ে গেছে, এর অনেক নজিরও আমাদের সামনে রয়েছে। সাম্প্রতিককালে ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ এবং ধর্ষণ-উত্তর হত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সরকার ধর্ষকের চূড়ান্ত শাস্তির বিধান রেখে আইন প্রণয়ন করলেও কেন এ ধরনের ঘটনার রাশ টানা যাচ্ছে না এ প্রশ্নের উত্তরও সচেতন মানুষমাত্রই জানা। বিলম্বিত বিচার কিংবা বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি, বিচার প্রক্রিয়ার ধাপে ধাপে নানা রকম জটিলতা, দায়িত্বশীলদের গালিফতি, আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাব ইত্যাদি বিষয় সমাজবিরোধী কিংবা অপরাধীদের সাহস জোগায় আরও অপরাধ সংঘটনে। উৎসাহিত করে দুষ্কর্মে লিপ্ত হতে। আমরা জানি, এই সমাজে নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষকে ন্যায়বিচার কিংবা যথাযথ প্রতিকার পেতে অনেক ক্ষেত্রেই নানা বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়। এও দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই বিদ্যমান ব্যবস্থাই মানুষের কল্যাণের পথ রুদ্ধ করে রেখেছে। এই পরিস্থিতিতে প্রশু দাঁড়ায়- ব্যবস্থার উন্নয়ন না করে অবস্থা পরিবর্তনের আশা কি দুরাশার নামান্তর নয়!

সমাজে কারা দুষ্কর্ম করে বেড়ায় কিংবা জননিরাপত্তার জন্য হুমকি, তাদের পুলিশ বা অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের না জানার কথা নয়। যে কোনো মামলা সাজানোর ক্ষেত্রে যদি গাফিলতি কিংবা ত্রুটি থাকে তাহলে আদালতে এর কাক্সিক্ষত ফল আশা করা যায় না। আদালত তো বিচার করবেন চার্জশিট ও সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে। যে কোনো অপরাধীর বিচার হয় মামলার তদন্তের ওপর। কিন্তু এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ার নানা ক্ষেত্রে দেখা যায় বড় রকমের অসংগতি এবং এর ফলে অপরাধীদের স্বস্তি পাওয়ার পথ খুলে যায়। আর অন্যদিকে শান্তিপ্রিয় মানুষের নিরাপত্তাহীনতার কারণগুলো আরও বেশি প্রকট হয়ে ওঠে। এমনটির দায় প্রথমত, পুলিশ একই সঙ্গে অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এড়াতে পারে না। আদর্শহীন রাজনৈতিক ও নীতিহীন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কারণে সমাজটা ক্রমাগত দুর্বৃত্তদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠছে। পৈশাচিকতা-বর্বরতার ছায়া বিস্তৃত হচ্ছে। কোনো মানবিক কিংবা সভ্য সমাজে এমনটি কাম্য হতে পারে না। সাধারণ মানুষের লালিত আকুতিÑ ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন জিইয়ে রেখে এর কোনোটিই কি নিশ্চিত করা সম্ভব। প্রশাসনের স্তরে স্তরে দায়িত্বশীলদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সরিষার ভেতর লুকিয়ে থাকা ভূত তাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে সর্বাগ্রে।

এই জরুরি বিষয়গুলো যে পর্যন্ত নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত সার্বিক পরিস্থিতি শান্তিপ্রিয় মানুষের অনুকূলে আনা কঠিন হয়েই থাকবে। আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রকদের অনেকেই উন্নয়ন-অগ্রগতি কিংবা নানা সহৃচকে আমাদের অনেক ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বগতির চিত্র তুলে ধরে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন। কিন্তু যে সমাজে এখনও মানুষের অধিকার, মানবিক মর্যাদা, নিরাপত্তা কিংবা জীবনের চলার পথে এত প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা জিইয়ে আছে, সেখানে এত আত্মতৃপ্তির অবকাশ কতটা আছে? অনস্বীকার্য, বিগত এক দশকে আমাদের উন্নয়ন-অগ্রগতি অনেক হয়েছে। কিš‘ কোনোভাবেই এই উন্নয়ন টেকসই হবে না যদি জননিরাপত্তা এবং জনঅধিকার নিশ্চিত করা না যায়। সমাজে বিবর্ণতার ছায়া বিস্তৃত হওয়ার মূলে হাত দিতে হবে এবং বিলম্বে হলেও এ কাজটি শুরু হোক কক্সবাজার থেকেই।

লেখক: নিবন্ধকার।

Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.