সৌদি সামরিক আগ্রাসনে দারিদ্র্যপীড়িত ইয়েমেন এখন ক্ষতবিক্ষত। কয়েকটি দেশের বিমান, নৌ ও সেনা হামলায় ইয়েমেন একেবারে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে; প্রতিদিন বইছে সেখানে রক্তের গঙ্গা। সৌদি আরবের এ আগ্রাসনে সঙ্গী হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর ও বাহরাইন। সৌদি আরবের সঙ্গে স্বার্থের ধান্ধায় যোগ দিয়েছিল আফ্রিকার দেশ সুদান, সেনেগাল ও মরক্কো। ২০১৫ সালে ২৬ মার্চ শুরু হয় আগ্রাসনে; এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ আর আহত হয়েছে বেশুমার। সৌদি জোটের হামলা থেকে বাদ যাচ্ছে না স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, খাবার তৈরির কারখানা কিংবা বিয়ের অনুষ্ঠান। প্রতিদিন নিহত হচ্ছে সাধারণ মানুষ, নারী-শিশু, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ। ঘর-বাড়ি খুইয়ে যেসব মানুষ উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে তারাও বাদ যাচ্ছে না হামলা থেকে।
সাম্প্রতিককালে ইরাক কিংবা আফগানিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে যেভাবে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিদেশি বাহিনীর বর্বর হামলায় মনুষ্য জনপদ বিরাণভূমিতে পরিণত হয়েছে কিংবা ইসরাইলের আগ্রাসনে যেমন অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে ঠিক একই অবস্থা তৈরি হয়েছে ইয়েমেনে। ইরাক ও আফগানিস্তানে সামরিক হামলার বিরুদ্ধে নিন্দাবাদ দেখা গিয়েছিল, বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ হয়েছিল। আবার গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রায় সারা বিশ্ব রুখে দাঁড়িয়েছিল কিš‘ ইয়েমেনে আগ্রাসনচললেও বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষ নীরব। ইরান ছাড়া কারো মুখে তেমন কোনো প্রতিবাদ নেই। সারা বিশ্বের নীরবতার মুখে ইয়েমেন নামে একটি দেশ, একটি জনপদ মুছে প্রায় যেতে বসেছে। গাজার মানুষ যেমন মুসলমান তেমনি ইয়েমেনের শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ মুসলমান। গাজায় ইসরাইল হামলা চালালে বিস্তুর প্রতিবাদ হয় কিন্তু ইয়েমেনের মুসলমানদের ওপর সৌদি আগ্রাসনের প্রতিবাদ হচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে- কী পার্থক্য ইসরাইলের আগ্রাসনআর সৌদি হামলার মধ্যে? ইসরাইলের হামলায় যেমন নিহত হয়েছে আদম সন্তান তেমনি সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের বিমান, নৌ ও স্থল হামলায় মারা যাচ্ছে একই রকমের আদম সন্তান; পার্থক্য তো কিছু নেই। এখানেও যদি কেউ শিয়া-সুন্নির কুতর্ক টেনে আনে তাহলে তারা কী নিশ্চয়তা দিতে পারবে- সৌদি জোটের হামলার যারা মারা যাচ্ছে তারা সবাই শিয়া? আর শিয়া হলেই কী তাদের হত্যা কী জায়েজ হয় যায়?
যদি বলা হয়- ইয়েমেনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গেছে সৌদি আরব। তাহলে পাল্টা প্রশ্ন আসে- সৌদি আরব কিংবা তার মিত্র আরব দেশগুলোতে গণতন্ত্র আছে?
যেভাবে শুরু ইয়েমেন সংকট: ২০১১ সালের গণজগরণ বা আরব বসন্তের ঢেউ দ্রুতই আছড়ে পড়ে ৩৩ বছরের স্বৈরশাসক শাসক আলী আবদুল্লাহ সালেহ শাসিত ইয়েমেনে। তখন সে গণজাগরণের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে আজকের হুতি বা জনপ্রিয় আনসারুল্লাহ আন্দোলন। মুখোমুখি দাঁড়ায় জনগণ ও সালেহ সরকার। হুতি আন্দোলনের নেতারাও বেশিরভাগই শিয়া মুসলমান, আবার সালেহও শিয়া ছিলেন। তখন সালেহর পক্ষ নেয়ার সময় শিয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠে নি। কিন্তু এখন যুদ্ধের মধ্যে সৌদি আরব ও তার সঙ্গীরা ইয়েমেনের সংকটকে প্রধানত শিয়া-সুন্নির দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে।
২০১১ সালের দিকে শুরু হওয়া আরব বসন্ত ঠেখানো খুবই জরুরি হয়ে পড়ে সৌদিসহ বেশরিভাগ আরব দেশের শাসকদের জন্য। আমেরিকা, ব্রিটেন ও ইসরাইলের সহায়তা নিয়ে সৌদি আরব সেই গণজাগরণ ঠেকাতে মাঠে নামে। সে সময় ইয়েমেনের ৩৩ বছর ক্ষমতায় থাকা স্বৈরশাসক সালেহকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেয় সৌদি আরব ও তার অনুসারিরা। সরকার-বিরোধী আন্দোলনে বহু লোককে হত্যা করা হয়েছে। আন্দোলন জোরদার হলে সালেহ পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন কিন্তু সে সময় সৌদি আরব নিজের স্বার্থে সালেহকে পদত্যাগ করতে দিতে চায় নি। কারণ ওই সময় পদত্যাগ করলে তার বিরাট প্রভাব পড়ত পুরো আরব বিশ্বে। সৌদি রাজাসহ অন্যদের ক্ষমতার স্থায়িত্ব নিয়ে অনিশ্চিয়তা দেখা দিত। যাহোক, নানা ঘটনার পর এক পর্যায়ে সৌদি আরবের নেতৃত্বে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ বা জিসিসি’র মধ্যস্থতায় সমঝোতা হয় এবং আলী আব্দুল্লাহ সালেহ পদত্যাগ করেন। ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে সালেহ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দ রাব্বু মানসুর হাদিকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সমঝোতা অনুসারে ২০১৪ সালে সংসদীয় নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মানসুর হাদি দায়িত্ব নেয়ার পর দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা বেড়ে যায়। হাদি নিজেও দক্ষিণঞ্চলীয় লোক। এছাড়া, জোরদার হয় কথিত আল-কায়েদার তৎপরতা; শেষ দিকে সেখানে যোগ হয়েছিল উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএস। ইয়েমেনে তৎপর আল-কায়েদার নেতৃত্বে রয়েছে যারা তাদের প্রায় সবাই সৌদি আরবের নাগরিক। এরা গুয়ান্তানামো কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ইয়েমেনে এসে ঘাঁটি করে। এ অবস্থায় ইয়েমেনের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি হুথি আন্দোলনও জোরদার হয়।
২০১১ সালে কৌশলে যে গণজাগরণ স্তব্ধ করা হয়েছিল সেই গণআন্দোলন নতুন করে বেগ পায়। ২০১৫ সালের শুরুতে আন্দোলনের মুখে মানসুর হাদির সরকার পদত্যাগ করে এবং হুথি নেতা আব্দুল মালেক আল-হুথির নেতৃত্বে রাজধানী সানার নিয়ন্ত্রণ হুথিদের হাতে চলে যায়। হুথি আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দেন সাবেক প্রেসিডেন্ট আলী আব্দুল্লাহ সালেহ। ফলে এ আন্দোলন আর শুধু হুথিদের আন্দোলন থাকল না। রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর-বন্দরেরও নিয়ন্ত্রণ নেয় হুথি ও সালেহর সমর্থকরা। এরইমধ্যে সংসদ বাতিল করা হয় এবং বিপ্লবী কমিটি গঠনের মাধ্যমে মুহাম্মাদ আলী আল-হুথিকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দিয়ে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। এ পরিবর্তনকে আব্দুল মালেক আল-হুথি “স্বর্ণোজ্জ্বল বিপ্লব” বলে অভিহিত করেন। কিš‘ গণবিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বিপ্লবী কমিটির কোনো কাজ ও ঘোষণা মেনে নিতে পারে নি সৌদি আরব ও তার সমর্থকরা। একই অবস্থানে চলে যায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জগত। নতুন সরকারের পক্ষে ২০১৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি নতুন সাংবিধানিক ঘোষণাকে তারা অবৈধ বলে আখ্যায়িত করে। সৌদি আরব ও তার আঞ্চলিক মিত্ররা ইয়েমেনের “নীরব গণবিপ্লব”কে হুথি শিয়াদের আন্দোলন বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। আর চিরাচরিত প্রথায় বিপ্লবী শক্তির বিরোধিতা করে মাঠে নামে আমেরিকা। শুরু হয় হুথি নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী কমিটিকে ক্ষমতাচ্যুত করার কর্মকাণ্ড।
এদিকে পরিস্থিতি আঁচ করে বিপ্লবী হুথিরা প্র্রেসিডেন্ট মানসুর হাদির প্রাসাদ ঘেরাও করে রাখে। কিন্তু ২০১৫ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি কোনোভাবে ম্যানেজ করে রাজধানী সানার প্রাসাদ থেকে পালিয়ে বন্দর নগরী এডেন চলে যান হাদি। এডেন হচ্ছে তার নিজের শহর। সেখান থেকে টেলিভিশনে পরদিন ভাষণ দেন। এ ভাষণে তিনি হুথিদের ক্ষমতাগ্রহণকে অবৈধ ঘোষণা করেন। হাদির ভাষণের পর সাবেক প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ নিন্দা জানান এবং হাদিকে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার আহ্বান জানান। এ সময় ইরান সরকারের বিরুদ্ধে হুথি আন্দোলনকে মদদ দেয়ার অভিযোগ আনেন মানসুর হাদি। তিনি বলেন, শিয়া রাষ্ট্র ইরান হুথি শিয়াদেরকে মদদ দিচ্ছে। এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার যে, ইরানের শিয়া মুসলমানরা বারো ইমামে বিশ্বাসী। এটা একেবারেই একটি মৌলিক বিষয়। অন্যদিকে, ইয়েমেনের হুথি আন্দোলনের নেতারা মূলত জাইদি শিয়া যারা পাঁচ ইমামে বিশ্বাসী। সে ক্ষেত্রে ইরানের শিয়া মুসলমানদের সঙ্গে ইয়েমেনের শিয়াদের বিরাট পার্থক্য রয়েছে। এছাড়া, ইয়েমেনে শিয়া মাজহাবের ইসমাইলি সম্প্রদায়ও রয়েছে যাদের সঙ্গে ইরানের শিয়া সম্প্রদায়ের আকিদাগত বিরাট পার্থক্য রয়েছে। যাহোক, ইরানের মতো ইয়েমেনের আরেক প্রতিবেশি ইরিত্রিয়ার বিরুদ্ধেও হুথি আন্দোলনকে সমর্থন যোগানোর অভিযোগ আনা হয়। তবে ইরিত্রিয়া সে অভিযোগ নাকচ করে। এ সম্পর্কে গোপন তথ্য ফাঁসকারী সাড়া জাগানো অনুসন্ধানী ওয়েবসাইট উইকিলিক্স বলেছে, “মার্কিন কর্মকর্তাদের অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, মানসুর হাদি ইরানকে অভিযুক্ত করছে মূলত রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য।”
রাতের আঁধারে আগ্রাসন শুরু: ইয়েমেন পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হলে এবং হাদি পালিয়ে যাওয়ার পর সৌদি আরব চূড়ান্তভাবে ইয়েমেনে হামলার ছক কষে ফেলে। এ কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন বর্তমান রাজার ছেলে মুহাম্মাদ বিন সালমান। ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ রাতের বেলা সৌদি আরবের নেতৃত্বে মিশর, মরক্কো, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও জর্দানের সম্মিলিত বিমান বাহিনী ইয়েমেনের ওপর হামলা চালায়। জাতিসংঘের কোনো অনুমতি ছাড়াই এ আগ্রাসনশুরু করে সৌদি আরব ও তার সহযোগীরা। আকস্মিক হামলায় কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে হুতি অনুগত ইয়েমেনের সেনারা। এছাড়া, দেশটির সামরিক বাহিনীর একাংশ হুতি আন্দোলন প্রতি অনুগত; বাকি অংশ হাদির প্রতি অনুগত। সব মিলিয়ে বিদেশি আগ্রাসনমোকাবেলার জন্য একটি দেশের যে সামরিক প্রস্তুতি থাকার দরকার তার কিছুই সেভাবে ছিল না। ধারণা করা হয়- প্রথম হামলাতেই ইয়েমেনের তুলনামূলক ছোট ও দুর্বল বিমানবহর ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হামলা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে সৌদি রাজা সালমান ঘোষণা করেন, সৌদি বাহিনী ইয়েমেনের আকাশের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়েছে। হামলায় গুঁড়িয়ে যেতে থাকে ইয়েমেনের শহর, বন্দর গ্রাম-জনপদ। সৌদি জোটের হামলার শিকার হয় শিয়া, সুন্নি নির্বিশেষে সব মাজহাবের সাধারণ মানুষ। এ কাজে আগ্রাসী সৌদি জোটকে প্রকাশ্যে লজিস্টিক ও গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহায়তা করে চলেছে বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রধান প্রবক্তা আমেরিকা।
হামলার মূল কারণ কী?: ইয়েমেনে সৌদি আরবের নেতৃত্বে আরব জোটের চলমান হামলার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। ২০১১ সালে শুরু হওয়া আরব বসন্তের ঢেউয়ে তিউনিসিয়ার স্বৈরশাসক জয়নাল বেন আলীর দ্রুত পতন ঘটে। তিনি সৌদি আরবে আশ্রয় নেন। পরিস্থিতি বুঝে ওঠার আগেই কিংবা পরিস্থিতি আপাতত সামাল দেয়ার জন্য মিশরে হোসনি মুবারকের গদি বিসর্জন দিতে হয়। এরপর দ্রুত টালমাটাল বাহরাইনে সেনা ও ট্যাংক পাঠায় সৌদি আরব। একইভাবে ইয়েমেন পরিস্থিতি সামলাতে সৌদি আরব ৩৩ বছরের স্বৈরশাসক আলী আব্দুল্লাহ সালেহকে দিয়ে ব্যাপক হত্যাকা- চালায় এবং নানা কৌশলে আন্দোলন স্তব্ধ করার চেষ্টা করে। সে সময় পরিস্থিতি সাময়িকভাবে সামাল দেয়া গেলেও মূলত দেশটিতে বিপ্লবের আগুন ধিকি ধিকি করে জ্বলতে থাকে। ২০১৫ সালে মানসুর হাদিকে উৎখাতের মধদিয়ে সে বিপ্লব অনেকটা পূর্ণাঙ্গতা পায়। কিন্তু সৌদি আরবের উঠোনের পাশের প্রতিবেশি ইয়েমেনে যদি বিপ্লবী সরকার ক্ষমতায় থাকে তাহলে সৌদি রাজতন্ত্রের জন্য তা বিরাট হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এর মধ্যে সিরিয়ায় রয়েছে ইরান সমর্থিত বাশার আল-আসাদের সরকার। পাশে ইরাকে গঠিত হয়েছে শিয়া প্রভাবিত সরকার। ওদিকে লেবাননে রয়েছে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহর মতো প্রতিষ্ঠিত শক্তি। ফিলিস্তিনে শক্তিশালী হয়ে উঠছে হামাস। এর ভেতরে ইয়েমেনে বিপ্লবী সরকার গঠিত হলে সৌদি আরবসহ আরব অঞ্চলের অনেক রাজা-বাদশা বা স্বৈরশাসকের জন্য বড় বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে। যেকোনো সময় আরব দেশগুলোতে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণবিস্ফোরণ ঘটতে পারে। সেই আশংকা থেকে সৌদি আরব এ অঞ্চলে তার মিত্রদেরকে নিয়ে ইয়েমেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে।
দ্বিতীয় যে কারণ তা হলো মার্কিন স্বার্থ। আমেরিকা ও পশ্চিমা অনেক দেশ বহু আগে থেকেই সৌদি আরবের মাধ্যমে এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদ লুটে নিচ্ছে। এজন্য নানা কায়দায় সৌদি প্রাসাদের ভেতরে যেমন প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি তৈরি করা রয়েছে তেমনি আঞ্চলিক নানা শক্তির ভয় দেখিয়ে বশে রেখেছে আমেরিকা। সৌদি আরবসহ এ অঞ্চলের একটি আরব দেশেও নির্বাচন হয় না। জনগণের সঙ্গে শাসকদের কোনো সম্পর্ক নেই। বেশিরভাগ দেশ সামরিক দিক দিয়ে তেমন শক্তিশালীও নয়। এ অবস্থায় নানা কায়দায় মার্কিন প্রশাসনের ওপর সৌদি আরবসহ বেশিরভাগ আরব দেশকে নির্ভরশীল করে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। ফলে এসব দেশের এখন একান্ত কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে মার্কিন স্বার্থ নিশ্চিত করা। ইয়েমেনের মতো ভৌগোলিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ যদি বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠিত থাকে তাহলে এ অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থ যেকোনো সময় হুমকির মুখে পড়তে পারে। সেই আশংকা থেকে আমেরিকাই মূলত সৌদি আরব ও অন্য দেশগুলোকে ইয়েমেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। সামরিক সমর্থনের আড়ালে তারা নিজেরাও হামলায় অংশ নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি ইসরাইলি জঙ্গিবিমানও ইয়েমেনে হামলা চালাচ্ছে বলে খোদ হুতি নেতারা অভিযোগ করেছেন।
তৃতীয়ত, ইয়েমেনের বাব আল-মান্দেব প্রণালী হচ্ছে তেল পরিবহনের ক্ষেত্রে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ একটি রুট। এটি ভূমধ্যসাগর থেকে লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরে যাওয়ার একমাত্র পথ। আবার ভারত মহাসাগর থেকে এডেন উপসাগর ও লোহিত সাগর হয়ে সুয়েজ খাল পাড়ি দিয়ে ভূমধ্যসাগর হয়ে পশ্চিমে যাওয়ারও গুরুত্বপূর্ণ পথ। বাব আল-মান্দেব খুবই সরু একটি প্রণালী। এ প্রণালী দিয়ে প্রতিদিন বিশ্বের শতকরা ৩০ ভাগের বেশি তেল ও গ্যাস রপ্তানি হয়। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে চীন, জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়াসহ এশিয়ার বাকি দেশগুলোর এ পথেই সব বাণিজ্য হয়। সেই বাব আল-মান্দেবের নিয়ন্ত্রণ যদি ইয়েমেনের হুথি বিপ্লবী সরকারের হাতে থাকে তাহলে মার্কিন ও পশ্চিমা স্বার্থ নিরংকুশ থাকার সম্ভাবনা কমে যায়। ওদিকে বিশ্বের তেল-গ্যাস ও অন্যান্য বাণিজ্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রুট হচ্ছে পারস্য উপসাগর। পারস্য উপসাগরের গুরুত্বপূর্ণ প্রণালী হচ্ছে হরমুজ যার প্রধান নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ইরানের হাতে। সৌদি আরবের একদিকে সাগর পথে বিপ্লবী ইরানের নিয়ন্ত্রণ আর অন্য পাশে বিপ্লবী হুথিদের নিয়ন্ত্রণ -এ অবস্থা কোনোভাবেই কাম্য নয় আমেরিকা ও সৌদি সরকারের। ফলে তারা সম্মিলিতভাবে ইয়েমেনের হুথি বিপ্লবীদের ওপর হামলা শুরু করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে কিছু হলেই যে শিয়া-সুন্নির তকমা লাগানো হয় তা মোটেই ঠিক নয়। মূল বিষয় হচ্ছে মার্কিন ও পশ্চিমা স্বার্থ। সেই স্বার্থ হাসিলের পথে ইরানসহ স্বাধীনচেতা দেশ ও সরকারগুলো বড় বাধা। সেই বাধা অপসারণের জন্য সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেনে হামলা চালাচ্ছে আমেরিকা ও তার মিত্ররা। এদের বিরুদ্ধে সস্তা সমর্থন পাওয়ার জন্য বার বার রং লাগানো হচ্ছে শিয়া-সুন্নির দ্বন্দ্ব।
(লেখক: সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক)
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh