ব্রিটিশ
আমল থেকেই বেশ জনপ্রিয়তা ছিল জামালপুরের ঐতিহ্যবাহী মাটির তৈরি বাসন পত্র, খেলনাসহ নানা রকমের ঘর সাজানো রকমারী
আসবাপত্র। প্রতিদিনের সাংসারিক কাজ কর্মে প্রয়োজনীয় আসবাপত্র যেমন হাড়ি পাতিল,পুতুল ,কলসি,ফুলের টপ,শিশুদের খেলনাসহ
আরো অনেক কিছু রয়েছে মাটির তৈরি। যা বাংলার ঘরে
ঘরে সুভা পেত। নানা দাদার কাছে শুনেছি মাটির কলসির পানি,আর পাতিলের রান্না
করা ভাতের স্বাদটাই নাকি আলাদা। জামালপুরের এই এতিহ্যবাহী মাটির
বাসন বা মৃৎশিল্প কালের
আর্বতনে হারিয়ে যেতে চলেছে।
জামালপুর
জেলার পালপাড়া ও বানিয়া বাজার
গ্রামে প্রায় শতাধিক পরিবারের এক হাজার সদস্য
এই মৃৎশিল্পের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ কর্ েআসছে। বেশ জাকঁজমক পূর্ণ পরিবেশে জীবন যাপন করে বেশ আনন্দেই দিন কাটাতো কুমার পাড়ার মানুষ। কিন্তু বর্তমান সময়ে বাজারে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক এলোমনিয়াম, ষ্টিল বোঞ্জের সামগ্রী পাওয়া যাওয়ায় এই মাটির জিনিসের
প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেছে। তাই বাজারে এখন আর মানুষ জন
মাটির বাসন পত্র ক্রয় করে না। এই শিল্পে মারাত্বক
ধস নেমে এসেছে। অভাব অনটন দারিদ্র্যতা গলা টিপে ধরেছে কুমার পাড়া পালপাড়ার মৃৎশিল্প পরিবারদের। ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া ভরণপোষণসহ পরিবারের ব্যয় ভার বহন করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। অনেকেই অভাবের তাড়না এই পেশা ছেড়ে
দিয়ে জীবন ও জীবিকার জন্য
অন্য পেশায় নেমে পড়েছে। যেমন রাজ মিস্ত্রি, কারখানার শ্রমিক,স্বর্ণকার শ্রমিক, হোটেল,মনিহারী দোকানসহ বিভিন্ন ভাবে আয় উর্পাজনের চেষ্টা
করছে। আবার অনেকেই বাপ দাদার ঐতিহ্য ধরে রাখতে এই পেশাতেই রয়েছে। বৈশাখী
মেলা, অষ্টমী মেলার সময় কিছু বিক্রি হলেও সারা মাস কোন বিক্রি হয় না। বর্তমানে
ফুলের টপ, শিশুদের খেলনা,ব্যাংক আর
হালকা কিছু সামগ্রী ছাড়া অন্য কিছু বিক্রি হয় না। সরকারি
ভাবে কোন সাহায্য সহযোগিতা না পাওয়ায় এই
মৃৎশিল্প পরিবারগুলো পড়েছে মারাত্মক অর্থনৈতিক অভাবে।
জামালপুর জেলার ব্রহ্মপুত্র নদ ঘেঁষা পালপাড়া
গ্রাম। আগে ঘন জঙ্গলে ঘেরা
ছিল এই এলাকা। গ্রামে
বসতি ছিল খুবই কম। বর্তমান সময়ে এলাকাটি গড়ে উঠেছে ঘন বসতিতে। ঘন
জঙ্গল সাফ হয়ে রূপ নিয়েছে ডিজিটাল গ্রামে। রাাস্তা ঘাট, মন্দির,আবাস ভূমি সব কিছরু উন্নতি
হয়েছে। পরিবর্তনের ছোঁয়া পড়েনি শুধু মৃৎশিল্পীদের জীবন মানে। আগে দেখা যেত ব্রহ্মপুত্র
নদে বড় বড় পাল
তোলা নৌকা এসে ভিড়ত। পালপাড়ার মাটির বাসন নৌকা ভরে নিয়ে যেত জেলা শহর থেকে ঢাকা
নারায়ণগঞ্জ,মুন্সীগঞ্জসহ দেশের অন্য জেলায়। কালের পরির্বতনে যেমন হারিয়ে গেছে স্বাদের ব্রহ্মপুত্র নদ তেমনি হারিয়ে
যাচ্ছে জামালপুরের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প।
এখন আর বর্ষা মৌসুমে
দেখা যায় না ব্রহ্মপুত্রের ভরা
যৌবনে প্লাবিত ঘোলাটে পানির স্বোত। চোখে পড়ে না সেই দানবী
আকৃতির পাল তোলা নৌকা। এই শিল্পের সাথে
জড়িতরা না পারছে শিল্পটিকে
ছেড়ে দিতে না পারছে ভালোভাবে
ধরে রাখতে। পালপাড়ার কয়েকজন প্রবীণ ব্যাক্তির সাথে কথা বলে জানা যায় বাস্তব সমস্যার বিষয়টির কথা। দীপালী রানী, ছবি রানী,মিনি পাল জানায় মাটির বাসন এখন আর তেমন বিক্রি
হয় না বলে বাসায়
অলস জীবন যাপন করছ্ েতারা। পাশাপাশি অন্য কাজের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে পাল বংশের অনেক পরিবার।
অমল
চন্দ্র পাল একজন সংগীত শিক্ষক তিনি বলেন বাপ দাদার আমলের এই মাটির শিল্পটি
ধরে রাখা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ বাজারে বিভিন্ন কোম্পানীর প্লাষ্টিক,ষ্টীল আর বোঞ্জের সামগ্রীর
সাথে মূল্য তফাতের কারণে মানুষ এখন আর মাটির বাসন
কিনতে আগ্রহ দেখাই না।
এখন মাটি ও লাকড়ির দাম
অনেক বেশি। পাশাপাশি শ্রমিকের মুজরিও অনেক বেড়েছে তাই এই শিল্পের ব্যবসায়ীরা
বাজার দখল ধরে রাখতে পারছে না। তিনি সরকারি সাহায্য সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতার কথা
বলেন। তা না হলে
এই শিল্পটি হারিয়ে যাবে। অনিমেষ পাল ভোজন পালসহ আরো অনেকেই বলেন মাটির বাসন বাজারে চলে না বলেই তারা
অনেকে এই পেশা ছেড়ে
দিয়ে বিভিন্ন পেশায় কাজ করছে। রণজিৎ পাল উজ্জ্বল পাল, পংকজ পাল হোটেল ও মনিহারি
ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছে। বিপুল পাল,উতুল, প্রতুল পালসহ অনেকেই রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। বানিয়া বাজার কুমার পাড়ার প্রদীপ পাল ময়না পাল টেইলারের ব্যবসা করেন। দীলিপ পাল কলার আড়ৎ নিয়ে বেশ আরাম আয়েশেই রয়েছেন। অনেকেই পরিবারের ব্যয়ভার মিটাতে দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। তার পরেও হাতেগুণা কিছু পরিবার বাপ দাদার ঐতিহ্যবাহী এই মৃৎশিল্পকে কোন
রকম ধরে রেখেছেন। এখন শুধু মাটির পুতুল খেলনা, ফুলের টপ ছাড়া অন্য
কিছু তেমন একটা বিক্রি হয় না। তাই
ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছেএই মৃৎশিল্প। যা রক্ষা করা
এখন সময়ের দাবি।
দেশের
বিভিন্ন জেলায় এই শিল্পটিকে ডিজিটাল
প্রযুক্তির আওতাই আনার জন্যে গবেষণা শুরু হলেও জামালপরের
ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পটি বাঁচাতে
কেউ এখনও নজর দেয়নি। বৈশাখী মেলা, অষ্টমী মেলার সময় কিছু বিক্রি হলেও সারা মাস কোন বিক্রি হয় না। প্রযুক্তির
উন্ন্য়নে দেশ এগিয়ে গেলেও এই শিল্পে উন্ন্য়নের
ছোঁয়া লাগেনি। এখনও হাতে চাকা ঘুরিয়ে মাটির বাসন তৈরি করা হয়। এই পদ্ধতিতে বিদুৎ
ব্যবহার করে শ্রম ও সময় বাঁচানো
যায়। লাকড়ির চুল্লির পরিবর্তে গ্যাস বা বিদ্যুৎ ব্যবহার
করে সাশ্রয়ী হওয়া যায়। ব্রহ্মপুত্র নদের তলদেশ থেকে কুমার মাটি সংগ্রহ করাটা আগে সহজ ছিল। এখন এই কুমার মাটি
সংগ্রহ করা খুব কঠিন এবং ব্যয় বহুল। উৎপাদন খরচের সাথে বাজার মূল্য সামঞ্জস্য না হওয়ায় অনেক
সময় লাভ তো দূরের কথা
আসল নিয়ে টানা টানি। তাই কুমার পাড়ার অনেকেই এই পেশা ছেড়ে
দিয়ে অন্য পেশায় উর্পাজনের চেষ্টা করছে। আর এ জন্যেই
হারিয়ে যাচ্ছে জামালপুরের ইতিহাস ঐতিহ্যের বাহক মৃৎশিল্পটি।
স্থানীয়
প্রশাসনের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই শিল্পটি বাঁচাতে
আলোচনা শুরু হয়েছে। নানাধিক ভেবে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে একটা প্রতিবেদন দেওয়া হবে। পাশাপাশি এই শিল্পের সাথে
জড়িত পরিবারগুলোকে আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন জামালপুরের জেলা প্রশাসক মহোদয়। জামালপুর জেলা পরিষদের প্রশাসক ও জেলা আওয়ামী
লীগের সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ চৌধুরী বলেন,এই ঐতিহ্যবাহি মৃৎশিল্পটি
আমাদের শিক্ষা সংস্কৃতি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতিক।
এই শিল্পটি রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। পাশাপাশি এই শিল্পের সাথে
জড়িত পরিবারগুলোকে সাহায্য সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেন। এই শিল্পটি বেচেঁ
থাকুক এটাই জামালপুরবাসীর প্রত্যাশা।
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর
যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204
ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।
© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh