× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

চা শিল্পের বিকাশে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে

মো. আরাফাত রহমান

০৩ জুন ২০২২, ১৪:০১ পিএম

প্রতীকী ছবি

চা একটি চির সবুজ উদ্ভিদ প্রজাতি, যার শুকানো পাতা থেকে তৈরি হয় জনপ্রিয় পানীয়৷ বাঙালির প্রতিটি ঘরে সকাল শুরু হয় ধোয়া উঠা এক কাপ গরম চা দিয়ে ৷ চা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি দ্রব্য যা দীর্ঘকাল থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিসেবে বিবেচিত। চা শিল্পে প্রায় দেড় লাখ লোক কর্মরত আছে। এটি বাংলাদেশে মূলত একটি কৃষিভিত্তিক, রপ্তানিমুখী বহুবর্ষজীবী ফসল। প্রাকৃতিক পরিবেশে চা গাছ ক্ষুদ্র বৃক্ষ আকারে বেড়ে ওঠে, কিন্তু পরপর ছাঁটাই ও অন্য পরিচর্যা যেমন: আগা কাটা, কুঁড়ি ভাঙা, সঠিক মাত্রায় পাতা-কুঁড়ি সংগ্রহ ইত্যাদি কারণে গাছের সাধারণ আকৃতির পরিবর্তন হয় চা গাছের তিনটি ধরন রয়েছে আসাম, চীনা ও ক্যামবোয়েড।

সাম্প্রতিক শ্রেণি বিভাগ অনুযায়ী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তিনটি ভৌগোলিক অঞ্চল অনুযায়ী চাষকৃত চায়ের তিনটি জাত হলো আসাম, চীনা ও ইন্দোচীনা। প্রথম দুটি চিহ্নিত ভ্যারাইটি আর তৃতীয়টি দক্ষিণাঞ্চলীয় বা ক্যামবোয়েড জাত হিসেবে পরিচিত। এভাবে রয়েছে হালকা পাতা ও গাঢ় পাতার আসাম জাত, তেমনি মণিপুরীর মতো ভ্যারাইটিগুলো। বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে উৎপন্ন চা গাছ বিমিশ্র। পাতার কোণ, অবস্থান, আকৃতি, রোমশতা ও বর্ণবৈচিত্র্যসহ নানা ধরনের চা গাছ দেখা যায়।

বাংলাদেশের চায়ের অধিকাংশ চারাই সংকর ও বিমিশ্র আর সেগুলোর চারিত্রিক ভিন্নতাও রয়েছে। বেশিরভাগ চা অবশ্য গাঢ় রঙের পাতার জাত। বাংলাদেশে চা চাষের সফল ও উৎপাদনশীল উন্নয়নে বনও একটি উপযোগী ভূমিক রাখে। বাংলাদেশের রয়েছে আবহমানকালের প্রাকৃ তিক বন ও রোপিত বনভূমি। এখনকার প্রাকৃতিক বনগুলো গ্রীষ্মমন্ডলীয় আধা-চিরহরিৎ ধরনের। বনাঞ্চলগুলো প্রধানত উচ্চ ভূমিতে এবং চা বাগানগুলোর অধিকাংশই উঁচু-নিচু পাহাড় ও উপত্যকায় অবস্থিত। বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে আসা বনাঞ্চলের বিপুল আবর্জনা প্রায়শ চা বাগানে জমা হয় বা আটকে পড়ে সেখানে যথেষ্ট পুষ্টি জোগায়। অধিকন্তু, ঘন ও গভীর প্রাকৃতিক ও রোপিত বনাঞ্চল প্রস্বেদনের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণ পানি ত্যাগ করার ফলে সেখানে উঁচু অর্দ্রতা বজায় থাকে। বনাঞ্চল বছরের বেশিরভাগ সময় অত্যধিক বৃষ্টিপাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে যা চা উৎপাদনের জন্য খুবই জরুরি। পাহাড় ও উঁচু উপত্যকার উপর দিয়ে প্রবাহিত প্রবল বাতাস ও ঝড়ঝঞ্ঝ থেকে বনাঞ্চল চা গাছকে রক্ষা করে

সংগ্রহ করার পর চায়ের পাতা কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করা হয়। বাংলাদেশে কালো চা সর্বাধিক জনপ্রিয় ও ব্যাপক ব্যবহৃত পানীয়। চা তৈরির মূল কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে চায়ের কুঁড়ি সংগ্রহ, প্রসসিং, রোলিং, গাঁজন, শুকানো, সেঁকা, মানানুযায়ী পৃথকীকরণ ও প্যাকিং। সংগৃহীত চা পাতা অর্থাৎ দু'টি পাতা একটি কুঁড়ির গুণাগুণের ওপর মানসম্পন্ন চা তৈরি বহুলাংশে নির্ভরশীল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৪ জুন ১৯৫৭ তারিখ হতে ২৩ অক্টেবর ১৯৫৮ তারিখ পর্যন্ত চা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত থেকে বাঙালি জাতিকে সম্মানিত করেন। বঙ্গবন্ধু চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে এবং পরবর্তীতে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে চা শিল্পের উন্নয়নে অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন। চা শিল্পে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য অবদান ও চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর যোগদানের তারিখকে স্মরণীয় করে রাখতে এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে চা শিল্পের ভূমিকা বিবেচনায় ৪ জুনকে 'জাতীয় চা দিবস' ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশ চা বোর্ডের উদ্যোগে 'মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, চা শিল্পের প্রসার' স্লোগান নিয়ে গত ৪ জুন ২০২১ তারিখে বর্ণাঢ্য আয়োজনে দেশের সকল চা উৎপাদনকারী অঞ্চলে উদযাপিত হয় ১ম জাতীয় চা দিবস।

বঙ্গবন্ধু চা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালীন মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকায় সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত ০.৩৭১২ একর ভূমির ওপর চা বোর্ডের প্রধান কার্যালয় নির্মাণ কাজ ত্বরান্বিত হয়। তিনি ১৯৫৭ সালে মৌলভী বাজারের শ্রীমঙ্গলে টি রিসার্চ স্টেশনের গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করে উচ্চ ফলনশীল জাতের ক্লোন চা গাছ উদ্ভাবনের নির্দেশনা প্রদান করেন। চায়ের উচ্চফলন নিশ্চিত করতে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এবং শ্রীমঙ্গল ভাড়াউড়া চা বাগানে উচ্চফলনশীল জাতের চারা রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তিনি “টি অ্যাক্ট-১৯৫০" সংশোধনের ওই মন্দার পর সিলেটের চা শিল্পে জেমস ফিনলে নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। তবে উনিশ শতকের শেষদিক হতে ক্ষুদ্র একটি দেশীয় উদ্যোক্তা শ্রেণি চা শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত হয়। তবে দেশীয় উদ্যোক্তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হলেও বিদেশি কোম্পনিগুলোর আধিপত্য কখনই বিঘ্নিত হয় নি। কারণ প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং চা বিপণনের জন্য দেশিয় চা করগণ ইউরোপীয়দের উপরই নির্ভর করত। তবে এই শিল্পের মাধ্যমেই দেশীয় ও বিদেশি উদ্যোক্তাদের মধ্যে এক ধরনের সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠে।

দেশ স্বাধীনের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে শুধুমাত্র দুইটি জেলায় চা আবাদ করা হতো, একটি সিলেট জেলায় যা ‘সুরমা ভ্যালি' নামে পরিচিত ছিল, আর অপরটি চট্টগ্রাম জেলায় যা 'হালদা ভ্যালি' নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে বৃহত্তর সিলেটের সুরমা ভ্যালিকে ছয়টি ভ্যালিতে ভাগ করা হয়েছে যথাক্রমে: লস্করপুর ভ্যালি, বালিশিরা ভ্যালি, মনু দলই ভ্যালি, লংলা ভ্যালি এবং নর্থ সিলেট ভ্যালি এবং হালদা ভ্যালিকে চট্টগ্রাম ভ্যালি করা হয়েছে।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চা বাগানসমূহ প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে যায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই শিল্পকে টেকসই খাতের উপর দাঁড় করানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি স্বাধীনতার পর “বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রিজ ম্যানেজমেন্ট কমিটি (ইঞওগঈ)” গঠন করে যুদ্ধোত্তর মালিকানাবিহীন/পরিত্যাক্ত চা বাগান পুনর্বাসন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এছাড়াও যুদ্ধে বিধ্বস্ত পরিত্যক্ত বাগানগুলোকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে বাগান মালিকদের নিকট পুনরায় হস্তান্তর করেন।

তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত চা কারখানাগুলো পুনর্বাসনের জন্য “ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া” থেকে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে চা শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির ব্যবস্থা গ্রহণ করেন চা শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষায় সরকার চা উৎপাদনকারীদের নগদ ভর্তুকি প্রদান করার পাশাপাশি ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহের ব্যবস্থা করে। উক্ত সার সরবরাহ কার্যক্রম এখনো অব্যাহত আছে। তিনি চা শ্রমিকদের শ্রমকল্যাণ নিশ্চিত করেন; যেমন-বিনামূল্যে বাসস্থান, সুপেয় পানি, বেবি কেয়ার সেন্টার, প্রাথমিক শিক্ষা এবং রেশন প্রাপ্তি । তিনি ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ টি রিসার্চ স্টেশনকে পূর্ণাঙ্গ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটে উন্নীত করেন। বর্তমানে তা বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইঞঞ্জও) নামে পরিচিত।

বর্তমান বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপের কারণে চা শিল্পের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। ১৯৭০ সালে চা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩১.৩৮ মিলিয়ন কেজি। ২০১৬ সালে ৮৫.০৫ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়, ২০১৮ সালে ৮২.১২ মিলিয়ন কেজি এবং ২০১৯ সালে রেকর্ড পরিমাণ ৯৬.০৭ কেজি এবং ২০২০ সালে ৮৬.৩৯ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়। এছাড়া ২০২০ সালে রেকর্ড পরিমাণ ২.১৭ মিলিয়ন কেজি চা রপ্তানি হয় ৷ এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামীতে চা আমদানির প্রয়োজন হবে না বরং রপ্তানির ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হবে।

১৯৭০ সালে বাংলাদেশে চা বাগানের সংখ্যা ছিল ১৫০ টি, বর্তমানে চা বাগানের সংখ্যা ১৬৭টি। বর্তমানে দেশে দু'টি চা নিলাম কেন্দ্র চট্টগ্রাম নিলাম কেন্দ্র এবং শ্রীমঙ্গল নিলাম কেন্দ্র রয়েছে । এছাড়াও ২০০২ সাল থেকে চা বোর্ড কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় পঞ্চগড়, লালম নিরহাট, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলায় ক্ষুদ্রায়তন চা আবাদ শুরু হয়েছে এবং ব্যাপক সফলতা লাভ করেছে । এছাড়া সরকার বাংলাদেশ চা শিল্পের উন্নয়নের জন্য ১১ টি কর্ম কৌশল অন্তর্ভুক্ত করে ‘উন্নয়নের পথনকশা: বাংলাদেশ চা শিল্প' শিরোনামে একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে যা আগামীতে দেশের চা শিল্পকে আরও এগিয়ে নিতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে।

লেখক: কলামিস্ট ও সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.