× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

পদ্মা সেতুর প্রভাব

নৌ-পথে যাত্রী কম, বেড়েছে সড়কে

শাহনাজ পারভীন এলিস

০৬ জুলাই ২০২২, ০৩:১৬ এএম । আপডেটঃ ০৬ জুলাই ২০২২, ০৩:৪৬ এএম

আগামী ১০ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদের বাকি আর মাত্র ৪ দিন। অথচ ঈদ উপলক্ষে এবার ঘরমুখো মানুষের তেমন ভিড় নেই লঞ্চ টার্মিনালে। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার সদরঘাটে গিয়ে দেখা যায়, অন্যবারের মতো এবারের দৃশ্যপট পাল্টেছে অনেক। হাঁকডাক করে লঞ্চে যাত্রী ওঠানোর প্রতিযোগিতা করছেন না ঘাটের কর্মচারীরা। লঞ্চের ডেকে কিছু থাকলেও কেবিনে যাত্রীর সংকট। বেশিরভাগ বিলাসবহুল লঞ্চের ৫০ ভাগ কেবিনই ফাঁকা। ঘাটে এবার অগ্রিম টিকিট কাটারও চাপ নেই। যাত্রী কম হওয়ায় ডেকের ভাড়াও ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ কমিয়েছে কিছু লঞ্চ।

লঞ্চের কেরানি ও কর্মচারীরা জানান, পদ্মা সেতুর প্রভাবে এবার যাত্রী কমেছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পরদিন থেকে যাত্রীর সংখ্যা কমতে শুরু করে। পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে বাড়ি যাওয়া আগ্রহীরা শখের বশে বাসে করে বাড়ি যাচ্ছেন। তবে ঘরমুখো মানুষের প্রকৃত অবস্থা জানা যাবে ঈদের পর।

সুন্দরবন-১০ লঞ্চের সুপারভাইজার জানান, লঞ্চের প্রকৃত যাত্রীরা লঞ্চেই যাতায়াত করতে পছন্দ করেন। তবে অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরা আগে যারা বিলাসবহুল কেবিনে যেতেন, পদ্মা সেতু হওয়ায় তারা এবার ব্যক্তিগত গাড়িতে করেই বাড়ি যাচ্ছেন। এতে করে কেবিনের যাত্রীর সংখ্যা কমেছে। পরিবারসহ যাচ্ছে যারা, লঞ্চেই আসছে তারা। বরিশালগামী যাত্রী প্রিন্স মাহমুদ বলেন, ‘প্রতিবার এ সময়ে ঈদের যাত্রীর ভিড় বেশি থাকে, লঞ্চে উঠতে অসুবিধায় পড়তে হয়। এবার সেই অবস্থা নেই, সাচ্ছন্দ্য লাগছে। লঞ্চে বাড়ি যেতে আমাদের ভালো লাগে, তাই লঞ্চেই যাচ্ছি। এতে একটু সময় বেশি লাগলেও স্বস্তিতে বাড়ি যাওয়া যায়। কিন্তু বাসে সেটা সম্ভব নয়। তবে এখন বাসে কম সময়ে যাওয়ার বিকল্প অপশন তৈরি হওয়ায় মন চাইলে বাসেও যাবো। দুই মাধ্যমে দু’রকম সুবিধা নেয়ার সুযোগ হয়েছে।’

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল যাত্রী পরিবহন সংস্থার সহ-সভাপতি এবং সুন্দরবন নেভিগেশনের মালিক সাইদুর রহমান রিন্টু সংবাদ সারাবেলাকে জানান, পদ্মা সেতু এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ দিনে স্বপ্ন পূরণ। তাই এপর্যায়ে পদ্মা সেতুর প্রতি মানুষের মাস দুয়েক সেতু আগ্রহ থাকবেই। কিন্তু এর ফলে লঞ্চের যাত্রী তেমন কমবে না। কারণ বাসে ঢাকা থেকে বরিশালে যেতে মাথাপিছু ভাড়া গুনতে হয় প্রায় ৬০০ টাকা। অথচ লঞ্চের ভাড়া মাত্র ২৫০ টাকা। এছাড়া লঞ্চযাত্রা সাশ্রয়ী, ক্লান্তিহীন ও আরামদায়ক। তাই লঞ্চের যাত্রীরা লঞ্চেই ফিরে  আসবে। তার লঞ্চ সুন্দরবনে ঈদের আগে ৭, ৮ ও ৯ জুলাইয়ের জন্য সব কেবিন অগ্রিম বিক্রি হয়েছে বলেও জানান সাইদুর রহমান। এই তিন দিনের জন্য স্পেশাল লঞ্চও চালু করা হবে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের নৌ পথে যাতায়াতে সাচ্ছন্দ্য ফিরে এসেছে বলেও মনে করেন তিনি।

বরিশাল নদীবন্দর সূত্রে জানা গেছে, ঈদে যাত্রীদের যেন কোনো ভোগান্তি না হয়, সেদিকে খেয়াল রেখে সেখানকার নদীবন্দরে পন্টুনের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছে। নৌপথে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন রোধ, ফিটনেসবিহীন যান চলাচল বন্ধ, ঈদের আগে ও পরে নদীতে বাল্কহেডসহ ঝুঁকিপূর্ণ নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা, নদীতে কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস, নৌ-পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএ-এর টহল নিশ্চিত করা, মেরিন ক্যাডেট, স্কাউট, গার্লস গাইডের সদস্যরা যাত্রীদের লঞ্চে ওঠা-নামাসহ সার্বিক সহযোগিতা করবেন।

লঞ্চ মালিক সমিতির সহ-সভাপতি আবুল কালাম খান বলেন, ‘পদ্মা সেতু দেখতে মানুষের আগ্রহ বেশি থাকায় এপর্যায়ে অনেকেই বাসে যাচ্ছেন। গুলিস্তান থেকে সদরঘাট আসতে রাস্তার বেহাল দশা আর জ্যামের কারণে অনেকে এদিকে কম আসতে চায়। সেজন্য তারা মাইক্রোবাস রিজার্ভ করে বরিশাল যাচ্ছেন। তবে যাত্রী ঠিক কতটা কমেছে তার তার সঠিক হিসাব আমরা ঈদের পর জানতে পারবো।’ লঞ্চ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা থেকে বিভিন্ন রুটে লঞ্চ চলাচল করে থাকে। তবে সবচেয়ে বড় লঞ্চগুলো চলে ঢাকা-বরিশাল রুটে। ঢাকা-বরিশাল নৌ-পথে ২৪টি লঞ্চের অনুমোদন আছে। গত ঈদে এই রুটে সব মিলিয়ে ১৮-২৬টি লঞ্চ চলাচল করেছে। তবে এ ঈদে যাত্রীর চাপ বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পদ্মাসেতু চালুর পর লঞ্চের ভাড়া কমানো হয়েছে। ঘাটের লঞ্চের টিকিট কাউন্টারের সূত্রে জানা যায়, ৪০০-৩৫০ টাকার পরিবর্তে ২০০-১৫০ টাকা করে ডেকে যাত্রী তোলা হচ্ছে। এছাড়া ২৪০০ টাকার ডাবল কেবিন বর্তমানে এসি অথবা নন-এসি ১৮০০-২০০০, ১৪০০ টাকার সিঙ্গেল কেবিন বর্তমানে এসি অথবা নন-এসি ১ হাজার থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সোফা বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়। 

বিআইডব্লিউটিএ’র পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগ) রফিকুল ইসলাম জানান, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় কেবিনে যাত্রী কমেছে ৫০ ভাগ আর সাধারণ যাত্রী ৩০ ভাগ। যাত্রী কিছুটা কমলেও বেড়েছে নিরাপত্তা। অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে এখন আর কাউকে লঞ্চে উঠতে হবে না। যাত্রীদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে ঈদ উপলক্ষে তাদের ব্যবস্থপনায় কোন ঘাটতি নেই। শুধু শিমুলিয়া-মাঝিরকান্দি ও শিমুলিয়া বাংলাবাজার রুটে মনিটরিং উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। কারণ পদ্মা সেতু চালুর পর এই দুই রুটে চলাচলকারী ৮৭টি লঞ্চ বন্ধ হয়েছে। তবে পদ্মা সেতু চালুর পর লঞ্চ ব্যবসার ঝুঁকি আছে বলে তিনি মনে করেন না। কারণ, এসব লঞ্চের আয়ের বড় উৎস হচ্ছে নিম্ন আয়ের যাত্রী, যাঁরা ডেকে কম খরচে আরামে যাতায়াত করেন। তারা দ্বিগুণ-তিন গুণ ভাড়া দিয়ে বাসে যাতায়াত করবেন না। তবে কেবিনে যাত্রী কিছুটা কমা স্বাভাবিক।

লঞ্চযাত্রীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বরিশাল নৌযাত্রী ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক দেওয়ান আবদুর রশিদ বলেন, পদ্মা সেতু লঞ্চ ব্যবসার জন্য কিছুটা হলেও মন্দাবস্থা তৈরি করবে। তবে লঞ্চমালিকেরা আন্তরিক হলে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এ জন্য লঞ্চে যাত্রীসেবার মান বাড়াতে হবে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আর ভাড়া হতে হবে সহনীয়। যাত্রীদের বিমার ব্যবস্থাও করা উচিত।

লঞ্চযাত্রীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বরিশাল নৌযাত্রী ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক দেওয়ান আবদুর রশিদ বলেছেন, পদ্মা সেতু লঞ্চ ব্যবসার জন্য কিছুটা হলেও মন্দাবস্থা তৈরি করবে। তবে লঞ্চমালিকেরা আন্তরিক হলে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এজন্য লঞ্চে যাত্রীসেবার মান বাড়াতে হবে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আর ভাড়া হতে হবে সহনীয়। যাত্রীদের বীমার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পরামর্শ তার।

নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালেদ মাহমুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, লঞ্চের যাত্রা যেমন আরামদায়ক, তেমনি নিরাপদ। আবার রাতের যাতায়াতে কর্মঘণ্টা নষ্ট হয় না। একটি লঞ্চে দেড়-দুই হাজার যাত্রী পরিবহন করা যায়। এতো পরিমাণ যাত্রী সড়কপথে পরিবহনে ৩৫ থেকে ৪০টি বাসের প্রয়োজন। কিন্তু এ অঞ্চলের সড়কগুলো এখনো সেভাবে প্রস্তুত হয়নি। তাই ভবিষ্যতেও নৌপথের জনপ্রিয়তা থাকবে। কারণ পণ্য পরিবহনে নৌ-পথে অপরিহার্য। যাত্রীবাহী লঞ্চের প্রয়োজনীতাও কমবে না। আর পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সারা দেশের মানুষের আগ্রহ বাড়ছে দক্ষিণাঞ্চলের প্রতি। বেড়েই চলেছে পর্যটকের সংখ্যা। তাই পর্যটনকেন্দ্রিক বিনিয়োগেরও চিন্তাভাবনা বেড়েছে। ফলে লঞ্চ মলিকরাও পর্যটক আকৃষ্ট করতে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করবে। এক্ষেত্রে লঞ্চে যাত্রীসেবার মান বাড়ানোর পরামর্শ এসেছে। নিয়মিত যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে পর্যটনে লঞ্চ অনেক বড় অবদান রাখবে। ভবিষ্যতে ঢাকা থেকে সুন্দরবন, কুয়াকাটা, চর কুকরি, হরিণঘাটা, চেংরাগিরিসহ অন্যান্য এলাকায় পর্যটকদের যাতায়াতের জন্য অনেক ব্যবসায়ী লঞ্চে বিনিয়োগের চিন্তাভাবনা করছেন। তাই পদ্মা সেতুতে নৌ পথে খুব একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন না তিনি। 


এদিকে পদ্মা সেতু হয়ে বাড়ি ফেরা মানুষের ভিড় বেড়েই চলেছে রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে। কারণ সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণবঙ্গের যাত্রীদের যাত্রাপথের সময় এক-তৃতীয়াংশ কমে এসেছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই সড়কপথে যাতায়াতে আগ্রহী হচ্ছেন অনেকে।

পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার পর থেকেই দক্ষিণবঙ্গের যাত্রীরা আরিচা ঘাট খুব কম ব্যবহার করছেন বলে জানান বাস মালিক-কর্মচারিরা। এ কারণে পদ্মা সেতু দিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য গুলিস্তান ও সায়দাবাদ বাস টার্মিনালে ভিড় যেন কমছেই না। গত ২৬ জুন থেকে এই রুটে যাত্রীর চাপ থাকলেও গত শনিবার থেকে যুক্ত হয়েছে ঈদে ঘরমুখো মানুষের চাপ।

গুলিস্তানের বিআরটিসি টার্মিনালে আসা বাসযাত্রী মিনহাজ আবেদিন জানান, ঈদ করতে পদ্মা সেতু হয়ে তিনি ফরিদপুরে গ্রামের বাড়ি যাবেন। আগে আরিচা হয়ে বাড়ি যেতেন। এখন মাওয়া হয়ে যাচ্ছেন। পদ্মা সেতু হওয়ায় বাড়ি যাওয়া সহজ হয়েছে। টিকিট পেতে একটু ঝামেলা হলেও পাওয়া যাচ্ছে। ঈদের আগে এটুকু ঝামেলা হবে এটাকে স্বাভাবিক মনে করছেন তিনি। টিকিট বিক্রেতারা জানান, আরিচা হয়ে মানুষ এখন বাড়ি যায় না। দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষ এখন পদ্মা সেতু হয়ে বাড়ি যায়। যাত্রীদের প্রচুর চাপ। তবে টিকিটের কোন সংকট নেই।

সায়েদাবাদ বিআরটিসির বাসচালক সুমন ব্যাপারী জানান, গত মাসের ২৬ তারিখ থেকেই যাত্রীর ভিড় বেড়েছে এই রুটে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে সেতু দেখার জন্য হলেও বাড়ি যাচ্ছে অনেকে। ঈদের শেষ দিন পর্যন্ত এই চাপ থাকবে বলেও জানান তিনি।

গুলিস্তান থেকে লোকাল পরিবহনে করেও পদ্মা পাড়ি দিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন হাজারো যাত্রী। প্রচেষ্টা পরিবহন গুলিস্তান থেকে ফরিদপুর ভাঙ্গা পর্যন্ত যায়। এই বাসের সুপারভাইজার রাকিব জানান, লোকাল বাস হওয়ায় তাদের যাত্রীর চাপ ভালোই। গত ঈদ থেকে এবারের ঈদে যাত্রী বেশি। গুলিস্তান থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত তারা ভাড়া নিচ্ছেন মাত্র ২৫০ টাকা। এছাড়া সায়দাবাদ বাস টার্মিনালেও ভিড় বেড়েছে দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীদের।

Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.