× প্রচ্ছদ বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতি খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফ স্টাইল ভিডিও সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি সংস্কৃতি

মোজাফ্ফর হোসেন

১১ জানুয়ারি ২০২২, ১০:৫৯ এএম

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন নেতা হয়ে ওঠেন তখন এই ভূখণ্ডে অনেক বড় বড় নেতা ছিলেন। এমন কী তারও আগে বঙ্গদেশে আরো অনেক গুণী নেতা এসেছেন। কিন্তু বাঙালি জাতির জন্য স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা কেউ করে যেতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুই একমাত্র সফল হয়েছেন। এর অনেক কারণের অন্যতম প্রধান কারণ বঙ্গবন্ধু কেবল রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন না, তিনি ছিলেন সংস্কৃতিকর্মীও। তিনি তৎকালীন পূর্ববাংলার জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে এক করতে পেরেছিলেন। তিনি বাংলার মানুষকে ধর্মীয় পরিচয়ের উপর নয়, সাংস্কৃতিক পরিচয়ের উপর এক কাতারে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর কারণে বাঙালি জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠেছে বাঙালি সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদ।
এই কারণে আমরা দেখি, তিনি ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় ও নেতৃত্ব স্থানীয় ভূমিকা রাখেন। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বাংলা ভাষা ছাড়া বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি রক্ষা করা যাবে না। বাংলা সংস্কৃতি রক্ষা করা না গেলে পূর্ব-পাকিস্তানের গণমানুষের অস্তিত্ব টিকে থাকবে না। বাংলা ভাষা মানে বাংলার লোকায়ত দর্শন, বাংলার লোকসংগীত, বাংলার শিল্পসাহিত্য সবই। তাই তিনি একদিকে যেমন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের সঙ্গে বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করছেন, অন্যদিকে তেমনি সাংস্কৃতিককর্মীদের সঙ্গে সংগ্রাম করছেন বাংলা ভাষা ও শিল্পের মর্যাদা রক্ষায়।

বঙ্গবন্ধু নিজেই ১৯৪৯ সালের ব্রাহ্মণবাড়িয়া সফরের স্মৃতি থেকে লিখেছেন: “নদীতে বসে আব্বাসউদ্দীন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলোও যেন তাঁর গান শুনছে। তাঁরই শিষ্য সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন তাঁর নাম কিছুটা রেখেছিলেন। আমি আব্বাসউদ্দীন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।’ আমি কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রাখতে চেষ্টা করেছিলাম।’’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ ১১১]
এরপর আমরা জানি তিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নেতৃত্স্থানে থেকেছেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ তিনি বাংলা ভাষার দাবি নিয়ে পালিত ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিয়ে কারাগারে যান। স্বাধীন পাকিস্তানে রাজনৈতিক জীবনে এটাই ত৭ার প্রথম কারাবাস। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন: ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। তাতে যাই হোক না কেন, আমরা প্রস্তুত আছি।’ [‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ ৯৯-১০০]
তিনি কেবল স্বভূমেই নয়, বিদেশেও বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছেন। পঞ্চাশের দশকে সেই চীন সফরে তিনি বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন: ‘...আমিও বক্তৃতা করলাম বাংলা ভাষায়। ভারতবর্ষ থেকে বক্তৃতা করলেন মনোজ বসু বাংলা ভাষায়। বাংলা আমার মাতৃভাষা, মাতৃভাষায় বক্তৃতা করাই উচিত। কারণ, পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের কথা দুনিয়ার সকল দেশের লোকই কিছু কিছু জানে।...দুনিয়ার সকল দেশের লোকই যার যার মাতৃভাষায় বক্তৃতা করে। শুধু আমরাই ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা করে নিজেদের গর্বিত মনে করি।’ [আমার দেখা নয়াচীন, পৃ ৪৩] অনুরূপভাবে আমরা দেখি তিনি ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথমবারের মতো অংশ নিয়ে বাংলায় ভাষণ দেন। জাতিসংঘের মতো বিশ্ব আসরে প্রথম বাংলা ভাষা উ”চারিত হয় বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে। এভাবেই বাঙালি ভাষা ও সংস্কৃতি তুলে ধরতে বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু শ্লাঘা বোধ করতেন।

তিনি কারাগারে বসে অসামান্য তিনটি গ্রন্থ’ রচনা করেছেন: ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়াচীন’। এই তিনটি গ্রšে’ বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তার প্রেম ও বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষায় আরো অনেক উদ্যোগের কথা জানা যায়।

বঙ্গবন্ধু তাঁর সম্পূর্ণ রাজনৈতিক জীবনে সবসময় লেখক ও শিল্পীদের সঙ্গে নিয়ে হেঁটেছেন। এটা তিনি শুরু করেছেন ছাত্ররাজনীতির শুরু থেকেই। ১৯৪১ সালে, বঙ্গবন্ধুর বয়স যখন মাত্র একুশ বছর, সেই সময়ের স্মৃতি থেকে তিনি জানাচ্ছেন: ‘একটা ঘটনার দিন-তারিখ আমার মনে নাই, ১৯৪১ সালের মধ্যে হবে, ফরিদপুর ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্স, শিক্ষাবিদের আমন্ত্রণ জানান হয়েছে। তাঁরা হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, ইব্রাহিম খাঁ সাহেব। সে সভা আমাদের করতে দিল না, ১৪৪ ধারা জারি করল। কনফারেন্স করলাম হুমায়ুন কবির সাহেবের বাড়িতে। কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব গান শোনালেন। আমরা বললাম, এই কনফারেন্সে রাজনীতি আলোচনা হবে না। শিক্ষা ও ছাত্রদের কর্তব্য সম্বন্ধে বক্তৃতা হবে।’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ ১৫-১৬]
সে-সময় পত্রিকার কর্মী হিসেবে তাঁর কাজ করার কথা জানা”েছন: ‘হাশিম সাহেব নিজেই সম্পাদক হলেন এবং কাগজ বের হলো। আমরা অনেক কর্মীই রাস্তায় হকারি করে কাগজ বিক্রি করতে শুরু করলাম। কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস সাহেবই কাগজের লেখাপড়ার ভার নিলেন। সাংবাদিক হিসেবে তাঁর যথেষ্ট নাম ছিল। ব্যবহারও অমায়িক ছিল। সমস্ত বাংলাদেশেই আমাদের প্রতিনিধি ছিলেন। তাঁরা কাগজ চালাতে শুরু করলেন। বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কাছে কাগজটা খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করতে লাগল। হিন্দুদের মধ্যেও অনেকে কাগজটা পড়তেন। এর নাম ছিল মিল্লাত।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ ৪০)
এরপর তিনি যতই পরিণত হয়েছেন তত লেখকশিল্পীদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। নিজে যখন লেখক তখন সেসব মুহূর্তের কথা স্মরণও করছেন উদারচিত্তে। বাংলা ভাষার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সংস্কৃতি, বিশেষ করে লোকায়ত সংস্কৃতিকে বুকে ধারণ করেছেন। কারুশিল্পী, চারুশিল্পী কোনো শিল্পমাধ্যমই বাদ যায়নি। তাঁর আন্দোলনে শক্তি জুুগিয়েছে আমাদের দেশীয় গ্রামীণ সাংস্কৃতিক ধারা। লোকশিল্পীরাও তাঁর আ¯’ার প্রতিদান দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি গান লিখেছেন বাংলার বাউল ও লোকশিল্পীরা। তাঁকে নিয়ে রচিত হয়েছে পুঁথিসাহিত্য। অর্থাৎ তিনি যে সংস্কৃতির সেবক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছেন, পরবর্তী সময়ে সেই সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁরই জীবন ও কর্মে। তিনি নিজেই আমাদের সংস্কৃতির উপাদান ও অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন। পঞ্চাশের দশক থেকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান বাঁধেন বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম। বঙ্গবন্ধু সিলেট-সুনামগঞ্জে রাজনৈতিক সফরে গেলে তাঁর সামনে তিনি গানগুলো গেয়ে শোনান। বঙ্গবন্ধু বলেন, করিম ভাই যেখানে, শেখ মুজিব সেখানে। বিখ্যাত লোকসংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দীনের গান শুনে তিনি জানা”েছন: ‘বাংলার গ্রামে গ্রামে আব্বাসউদ্দীন সাহেব জনপ্রিয় ছিলেন। জনসাধারণ তাঁর গান শোনার জন্য পাগল হয়ে যেত। তার গান ছিল বাংলার জনগণের প্রাণের গান। বাংলার মাটির সঙ্গে ছিল তার নাড়ির সম্পর্ক।’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ ১১১] বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে সেখানেও তিনি কয়েদিদের কণ্ঠে গান শোনার জন্য আকুল হয়ে থাকতেন। তিনি নিজেই জানাচ্ছেন: “...গান গাও নুরু, তোমার গান শুনি, ভালো লাগছে তো আমারও।’ অনেক গান গাইল, বললাম, ‘বাংলার মাটির সাথে যার সম্বন্ধ আছে, সেই গান গাও।’ আমি বারান্দায় মাটিতে বসে পড়লাম। নুরু ওর সেলের বারান্দার কাছে বসে গান করতে শুরু করল। অনেকক্ষণ গান শুনলাম। [কারাগারের রোজনামচা, পৃ ১৩০]
লোকায়ত সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের মূলধারার শিল্পসাহিত্যের সঙ্গেও সম্পর্ক রেখেছেন। খোঁজখবর রেখেছেন নিয়মিত। অন্তরে ধারণ করতেন বাংলা সংস্কৃতির দুই প্রাণ: রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে। দুজনের অনেক গান ও কবিতা তাঁর মুখস্থ ছিল। সুযোগ পেলেই তাঁদের রচনা থেকে উদ্ধৃতি টানতেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দীর্ঘ কারাভোগের পর স্বদেশের মাটিতে পা রেখে তিনি রবীন্দ্রনাথ থেকে আবৃত্তি করেছেন। ১৯৭২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাষণ দেওয়ার সময়ও তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করেছেন।

পাকিস্তানে স্মৃতি থেকে পাঠ করেছেন নজরুলের কবিতা। বাংলা একাডেমি আয়োজিত ১৯৭২ সালের ৮ মে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকীতে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে লক্ষ লক্ষ প্রাণ ও অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে। কিš‘ সত্য, শ্রেয়, ন্যায় ও স্বাজাত্যের যে চেতনা বাঙালি কবিগুরুর কাছ থেকে লাভ করেছেন, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে তারও অবদান অনেকখানি। বাঙালির সংগ্রাম আজ সার্থক হয়েছে। বাঙালির রবীন্দ্র-সম্মাননার চেয়ে বড় কোনো দৃষ্টান্ত আমার জানা নেই।’ নজরুল একাডেমি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলার বিদ্রোহী আত্মা ও বাঙালির স্বাধীন ঐতিহাসিক সত্তার রূপকার। বাংলার শেষ রাতের ঘন অন্ধকারে নিশীথ নিশ্চিন্ত নিদ্রায় বিপ্লবের রক্তলীলার মধ্যে বাংলার তরুণরা শুনেছে রুদ্র বিধাতার অট্টহাসি কালভৈরবের ভয়াল গর্জনÑনজরুলের জীবনে, কাব্যে সংগীতে, নজরুলের কণ্ঠে। প্রচণ্ড সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের মতো, লেলিহান অগ্নিশিখার মতো, পরাধীন জাতির তিমির ঘন অন্ধকারে বিশ্ববিধাতা নজরুলকে এক স্বতন্ত্র ছাঁচে গড়ে পাঠিয়েছিলেন এই ধরার ধূলায়। সাহিত্যে সম্মানের সুউচ্চ শিখরে নজরুলকে পথ করে উঠতে হয়নি, পথ তাঁকে হাত ধরে ঊর্ধ্বে তুলেছে। সে এসেছে ঝড়ের মাতম তুলে বিজয়ীর বেশে।...সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে নজরুলের অগ্নি-মন্ত্র বাঙালি জাতির চিত্তে জাগিয়েছিল মরণজয়ী প্রেরণা-আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হওয়ার সুকঠিন সংকল্প।’

বঙ্গবন্ধু একদিকে যেমন নজরুলের কবিতা থেকে তিনি ‘জয় বাংলা’ স্লোগান নেন, যে সেøাগান আমাদের লক্ষ কোটি প্রাণকে স্বাধীনতার পথে উজ্জীবিত করেছে; অন্যদিকে আবার স্বাধীন রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত নির্বাচন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান থেকে, যে গান আমাদের অসাম্প্রদায়িক বাংলা সংস্কৃতির আধার হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ তিনি রাজনৈতিক স্লোগান থেকে জাতীয় সংগীত নির্বাচনে কোথাও নিজের ধর্মীয় পরিচয়কে বড়ো করে তোলেননি, তিনি তাঁর বাঙালি পরিচয়কে আমাদের জাতীয় পরিচয় করে তুলেছেন। অন্যভাবে বাংলা সংস্কৃতিচর্চা যে রবীন্দ্র্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়া অসম্ভব সেটা তিনি নানাভাবে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। মনে রাখা প্রয়োজন, তিনিই স্বাধীন বাংলাদেশে কাজী নজরুল ইসলামকে ঢাকায় নিয়ে আসেন এবং জাতীয় কবির মর্যাদা দেন।

রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ছাড়াও বঙ্গবন্ধু আরো অনেকের লেখা পছন্দ করতেন। শরৎচন্দ্রের ‘আঁধারের রূপ’ প্রবন্ধটির কথা এসেছে কারাগারের রোজনামচায়। শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসটি ১৯৬৬ সালে কারাগারে বসে বঙ্গবন্ধু লিখছেন: ‘বন্ধু শহীদুল্লাহ কায়সারের সংশপ্তক বইটি পড়তে শুরু করেছি। লাগছে ভালোই...।’

বাংলা ভাষার অগ্রগণ্য লেখকদের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তরুণ লেখকদেরও মনোযোগসহকারে পাঠ করতেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে একটা ঘটনা তুলে ধরছি। মুক্তিযুদ্ধের আগে ১৯৬৭ সালে বঙ্গবন্ধু নিয়ে একটি কবিতা লেখেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। কবিতাটি ‘প্র”ছদের জন্য’ শিরোনামে ১৯৬৭ সালে ১২ নভেম্বর  দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত হয়। বঙ্গবন্ধু তখন জেলখানায়। লতিফ সিদ্দিকী তাঁকে এই কবিতাটা পড়তে দিয়েছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত বঙ্গবন্ধুকে পড়ে শোনালে বঙ্গবন্ধু উচ্চকন্ঠে হেসে বলেন, ‘আপনারা আমাকে চিনতে পারেন নাই, কবি আমাকে চিনতে পারছে।’ [তথ্যসূত্র: নির্মলেন্দু গুণের সাক্ষাৎকার, বিডিআর্টস] কবিতাটি পরে ‘স্বদেশের মুখ শেফালি পাতায়’ শিরোনামে ‘ প্রেমাংশুর রক্ত চাই' কাব্যগ্রন্থে’ অন্তর্ভুক্ত হয়। দ্বিতীয় কবিতাটি নির্মলেন্দু গুণ লেখেন ১৯৭০ সালে ‘হুলিয়া’ শিরোনামে। কবিতায় তিনি লেখেন: “আইয়ুব খান এখন কোথায়? শেখ মুজিব কি ভুল করছেন?” এই কবিতা নিয়ে পরে আবদুল গাফফার চৌধুরী ‘তৃতীয় মত’ কলামে লিখলেন। তিনি লিখলেন যে কবি কণ্ঠে এই সময়ের সবচেয়ে জরুরি প্রশ্নটি উ”চারিত হয়েছে। সময়কে ধারণ করে এটি রচিত হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম তরুণ কবিরা জীবনবিমুখ, কিš‘ এই কবিতাটি শুনার পরে মনে হচ্ছে নতুন একদল তরুণ কবি আসছে যারা স্বাধীনতার শপথ নিয়া বঙ্গবন্ধুর সহযোগী হতে চায়। [ আমার কণ্ঠস্বর, নির্মলেন্দু গুণ, কাকলী প্রকাশনী ২০১৫]
‘হুলিয়া’ নিয়ে গাফফার চৌধুরী ‘তৃতীয় মত’ পড়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, “এই কবি তো আমাকে নিয়ে কবিতা লিখছিল সেই সিক্সটি সেভেনে, আমি তখন জেলে ছিলাম। এই কবি আমার সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করলো, কেন? কোথায় থাকে এই কবি। আমার সঙ্গে একবার কথা বলাতে পার কিনা এই কবির। কোথায় থাকে জান?” [নির্মলেন্দু গুণের সাক্ষাৎকার, বিডিআর্টস]
শুধু পঠনপাঠন নয়, তিনি লেখকদের সম্মান করতেন হৃদয় থেকে। স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রনায়ক হয়েও লেখকের সামনে তাঁর বিনয় অটুট ছিল। ১৯৭৪ সালে দেশের প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে প্রধান অতিথির পদ অলঙ্কৃত করার আমন্ত্রণ জানানো হলে তিনি তাঁর ¯’লে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ও পল্লী কবি জসীমউদদীনের নাম বলেছিলেন। তিনি সেই সম্মেলনে প্রধান অতিথি হওয়ার সম্মতি দিয়েছিলেন এই শর্তে: মূল সভাপতি হবেন আমার বন্ধু পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, আর আমার দুই পাশে থাকবেন একজন বন্ধু এবং একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। একপাশে থাকবেন আমার বন্ধু শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এবং আরেক পাশে থাকবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী। [সাক্ষাৎকার: শামসুজ্জামান খান, বিডিনিউজ২৪.কম, ৯ই জানুয়ারি ২০২০] এই ঘটনার পাশাপাশি রাষ্ট্রনায়ক হয়েও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে ‘স্যার’ সম্বোধন করার ভেতর দিয়ে বোঝা যায় তিনি লেখকদের কতটা সম্মান দেখাতেন।

স্বাধীন দেশের সেই প্রথম সাহিত্যসম্মেলনে বক্তৃতাদানকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘জনগণই সব সাহিত্য ও শিল্পের উৎস। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনোদিন মহৎ সাহিত্য বা উন্নত শিল্পকর্ম হতে পারে না।’ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভেতর দিয়ে সদ্য-স্বাধীন দেশের সাহিত্যের স্বরূপ ও সাংস্কৃতিক চেতনা কেমন হতে পারে সে বিষয়েও তিনি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। যে জাতি সংগ্রাম করে স্বাধীন হয়েছে সে জাতির শিল্প-সাহিত্য জনবিচ্ছিন্ন হতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর এই অল্প কথার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যে গতি-প্রকৃতি অনুধাবন করা যায়।

গবেষক গোলাম মুরশিদের কথা দিয়ে ইতি টানছি: বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় অবদান হলো বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া। কিন্তু‘ তার সঙ্গে সঙ্গে একটা মস্তবড় অবদান হচ্ছে বাঙালি জাতির জন্য একটা স্বদেশ ভূমি গড়ে তোলা। বাংলার সংস্কৃতিকে অক্ষয় রূপ দিয়ে গেছেন শেখ মুজিব। তাঁর জন্যেই বাঙালি জাতি বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং সংগীতের চর্চা করতে পারছে এবং পারবে। এবং পৃথিবীতে একটিমাত্র দেশ আছে, বাংলা ভাষা যে দেশের রাষ্ট্রভাষা। বাঙালি সংস্কৃতি যে দেশের সংস্কৃতি। [বঙ্গবন্ধু বাঙালি সংস্কৃতির ভবিষ্যতও নির্মাণ করে দিয়েছেন, গোলাম মুরশিদ, বিডিনিউজ২৪.কম, ঢাকা, ২৫ মার্চ, ২০২০]


Sangbad Sarabela

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী আবু জাফর

যোগাযোগ: । 01894-944220 । [email protected], বিজ্ঞাপন: 01894-944204

ঠিকানা: বার্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ : বাড়ি নম্বর-২৩৪, খাইরুন্নেসা ম্যানশন, কাঁটাবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2024 Sangbad Sarabela All Rights Reserved.