বিশ্বের পঞ্চম দেশ হিসেবে চাঁদের মাটি ছুঁয়ে এবার ইতিহাস সৃষ্টি করলো এশিয়ার আরেক দেশ জাপান। দেশটির মনুষ্যহীন চন্দ্রযান ল্যান্ডার স্লিম (মুন স্নাইপার) চাঁদের মাটিতে অবতরণ করেছে।  

গত শুক্রবার (১৯ জানুয়ারি) জাপানের স্থানীয় সময় রাত ১২টা ২০ মিনিটে দেশটির চন্দ্রযান স্মার্ট ল্যান্ডার ফর ইনভেস্টিগেটিং মুন (স্লিম) চাঁদের শিওলি কার্টার নামের একটি এলাকায় অবতরণ করে।

জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (জাক্সা) এক বিবৃতিতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। এতে বলা হয়েছে, শুক্রবার চন্দ্রযান ল্যান্ডার স্লিম চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করেছে। তবে নভোযানটির সোলার প্যানেলগুলো কাজ করছে না। এ কারণে ব্যাটারি থেকে ‘ব্যাকআপ’ শক্তি নিয়ে এগোতে হচ্ছে স্লিমকে। ফলে মিশনটি রয়েছে হুমকিতে।

চাঁদের যে অঞ্চলটি বর্তমানে সূর্যালোক পাচ্ছে না, শিওলি কার্টারের অবস্থান সেখানে। তবে চলতি মাসের শেষের দিকে অবশ্য এই অঞ্চলটি আড়ালে চলে যবে।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাপানের মহাকাশ সংস্থার একটি রোবট সফলভাবে চাঁদে নেমেছে। তবে মহাকাশযানটির সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। এখন ব্যাটারির ওপর নির্ভর করছে যানটি। ব্যাটারির শক্তি থাকবে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা। ফলে এই মিশন হুমকির মুখে পড়তে পারে। 

জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা জাক্সা জানিয়েছে, চন্দ্রযানটি ল্যান্ড করার পরক্ষণেই প্রকৌশলীরা বুঝতে পারেন যে, এটিতে কিছুএকটা সমস্যা হয়েছে। পরে বুঝতে পেরে ব্যাটারি শেষ হওয়ার আগেই সোলার জেনারেটর ঠিক করার চেষ্টা চালাচ্ছে জাক্সা।

গত শুক্রবার মধ্যরাতেই এক সংবাদ সম্মেলনে জাক্সার গবেষণা বিভাগের প্রধান হিতোশি কুনিনাকা বলেন, ‘এক মাস আগে চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করে স্লিম। সে সময় সূর্যের অবস্থান যেখানে ছিল এখন আর সেখানে নেই। ফলে গত বেশ কয়েক দিন ধরেই সৌরশক্তি গ্রহণ করতে পারছে না স্লিমের সোলার প্যানেলগুলো।’

বর্তমানে স্লিমের ব্যাটারিতে যে পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত রয়েছে, তাতে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা নভোযানটি সচল থাকবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান কুনিনাকা।

তিনি বলেন, ‘শিওলি কার্টার ও তার আশপাশের এলাকায় যখন পূর্ণমাত্রায় সূর্যালোক পড়া শুরু হবে, তখন স্লিমও ফের সচল হবে।’

চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণের কিছুক্ষণ পর স্লিম থেকে সিগন্যাল আসাও বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার ডিপ স্পেস নেটওয়ার্ক। তবে শক্তির অভাবে সিগন্যাল পাঠানো বন্ধ হয়ে গেছে, না কি শক্তি সঞ্চয়ের জন্য নভোযানটি সিগন্যাল পাঠানো বন্ধ রেখেছে তা এখনও স্পষ্ট নয়।

তবে চাঁদে অবতরণ পুরোপুরি সফল হয়েছে নভোযানটির। হিতোমি কুনিনাকা জানান, ‘শিওলি কার্টারে এলাকায় ১০০ মিটারের (৩২৮ ফুট) মধ্যে স্লিমকে নামানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, এবং সেই অনুযায়ীই অবতরণ করেছে স্লিম।’ খবর বিবিসি ও রয়টার্সের 

সংবাদ সম্মেলনে কুনিনাকা বলেন,‘যানটি নামার আগে দেখে নেওয়া হয়েছিল কোথাও কোনও বাধা রয়েছে কিনা। ৫০ মিটার দূর থেকে সেটি পরীক্ষা করে দেখা হয়। সেই মতো সবুজ সংকেত পাওয়ার পরেই পালকের মতো চাঁদের বুকে নামে স্লিম।’

গত বছর ৭ সেপ্টেম্বর ‘স্লিম’র সফল উৎক্ষেপণ করেছিল জাপান। দেশটির ফ্ল্যাগশিপ রকেট এইচ-৩ বহন করে নিয়ে গিয়েছিল স্লিমকে। তারপর গত ২৫ ডিসেম্বর চাঁদের কক্ষপথে যানটি প্রবেশের কথা জানিয়েছিল জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা জাক্সা।

অবতরণের পরে চাঁদের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা চালানোর কথা ছিল স্নাইপারের। লক্ষ্য ছিল চাঁদের জন্ম, বিবর্তন নিয়ে তথ্য সংগ্রহের।

জাপানের ল্যান্ডার স্লিম (স্মার্ট ল্যান্ডার ফর ইনভেস্টিগেশন মুন) থেকে চাঁদের বুকে নামা রোভারটির এক্স-রে ছবি তোলার কথা রয়েছে। কৃষ্ণগহ্বর, নিউট্রন স্টার এবং সুপারনোভার উচ্চ মানের এক্স-রে তুলে জাপানের মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্রে পাঠাতে পারলে সেগুলোর গঠন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাবেন বিজ্ঞানীরা। 

এই যাত্রা অবশ্য সহজ ছিল না। গত কয়েক বছর ধরে চাঁদে নভোযান পাঠানোর চেষ্টা চালিয়ে আসছিল জাপান, কিন্তু প্রতিবারই কোনো না কোনো কারণে ব্যর্থ হয়েছে সেসব চেষ্টা। সর্বশেষ গত বছর মার্চেও একবার চন্দ্রযান স্লিমকে উৎক্ষেপণের চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু বৈরী আবহাওয়ার কারণে তা ব্যর্থ হয়।

চাঁদের মেরু অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকাগুলোতে অক্সিজেন, পানি ও ধাতব পদার্থের অনুসন্ধানই জাপানের চন্দ্রাভিযানের প্রধান উদ্দেশ্য। শুক্রবারের সংবাদ সম্মেলনে হিতোশি কুনিনাকা জানিয়েছেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে চাঁদে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়েছে জাক্সা। সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন অনেকাংশে নির্ভর করছে এই অভিযানের সাফল্যের ওপর।

এর আগেও যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন এবং ভারত- এই চারটি দেশ চাঁদে সফলভাবে নভোযান পাঠাতে পেরেছিল। এই তালিকায় এবার পঞ্চম দেশ হিসেবে ঢুকল জাপান।